আল্লাহর ফ্যালাসি যখন বিশ্বাস হয় যুক্তির মুখোশ



 ভূমিকা


আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করি, যেখানে প্রশ্ন তুললেই কুৎসা, যুক্তি দিলেই অবিশ্বাসী আর গবেষণা মানেই ঈমান নষ্ট। ধর্মীয় বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে একটি বাণী:


> “আল্লাহ জানেন”,

> “আল্লাহর কাজের ব্যাখ্যা হয় না”,

> “তোমার জ্ঞান সীমিত, আল্লাহর জ্ঞান অসীম”।


এইসব কথা শুনতে বিশ্বাসজাগানিয়া হলেও, বাস্তবে এগুলো একটি ভয়ঙ্কর যুক্তিগত ফাঁদ। একে বলা যায়—**"আল্লাহর ফ্যালাসি"।**




সংজ্ঞা: আল্লাহর ফ্যালাসি কী?


"আল্লাহর ফ্যালাসি" হলো একটি **বিশ্বাসগত যুক্তি ভ্রান্তি**, যেখানে অজানা, অসঙ্গত বা অসার কোনো বিষয়কে অযৌক্তিকভাবে “আল্লাহর জ্ঞান” বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে প্রশ্ন করা, যুক্তি খোঁজা, কিংবা প্রতিরোধ করাকে পাপ বা ঈমানহীনতা বলে মনে করা হয়।


ইসলামিক রেফারেন্স ব্যবহার করে কীভাবে এই ফ্যালাসি কাজ করে?


উদাহরণ ১:


সূরা নিসা ৪:১১-১২ — উত্তরাধিকার আইন।


এই আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু পরিস্থিতিতে মোট অংশ ১২/১২ এর বেশি হয়ে যায় (যেমন: 13/12, 17/12)।

👉 উদাহরণস্বরূপ: একজন নারীর মৃত্যুর পর তার কন্যা, স্বামী, বাবা ও মা থাকলে, ভাগের হিসাব ১৩/১২ হয়ে যায়—যা গাণিতিকভাবে অসম্ভব।


➡ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে:


> "আল্লাহ জানেন",

> "আল্লাহর জ্ঞানে ভুল নেই",

> "তুমি বুঝো না কারণ তুমি মানুষ"।


এই বক্তব্য বাস্তবে কী? এটি হলো: **যুক্তির বদলে ঈশ্বরীয় ক্ষমতা invoke করে প্রশ্ন বন্ধ করা।**


উদাহরণ ২:


**সূরা আনআম ৬:১০১** —


> "তিনি আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা। কিভাবে তাঁর সন্তান থাকতে পারে, যখন তাঁর কোনো স্ত্রী ছিল না?"


এই আয়াতে আল্লাহ নিজেই বলছেন, তাঁর স্ত্রী না থাকায় সন্তান সম্ভব নয়।

👉 অথচ এই যুক্তির ভিত্তিতে প্রশ্ন উঠবেই—**তাহলে আদম কীভাবে সৃষ্টি হলো? মেরি কীভাবে সন্তান লাভ করলো?**


➡ আবার উত্তর আসে:


> “আল্লাহ যা চান তাই করতে পারেন”

> 👉 অর্থাৎ আবার সেই **আল্লাহর ফ্যালাসি**— যেখানে যুক্তি স্থগিত হয় অলৌকিকতার ছায়ায়।




এই ফ্যালাসি কেন বিপজ্জনক?


1. **জ্ঞানচর্চাকে রুদ্ধ করে দেয়:**

   কারণ "আল্লাহ জানেন" বলেই আর কেউ প্রশ্ন তোলে না।


2. **যুক্তির জায়গায় ভয়ের প্রাচীর তুলে দেয়:**

   “প্রশ্ন করলে ঈমান নষ্ট” — এই ভয় মানুষকে চিন্তাহীন রাখে।


3. **মৌলবাদকে শক্তি দেয়:**

   কারণ যখন যুক্তি থেমে যায়, তখন কর্তৃত্বশীল ইমাম, মুফতি, ও মোল্লারা একচেটিয়া সত্য ঘোষণা করতে পারে।



ফলাফল:


"আল্লাহর ফ্যালাসি" মূলত একটি **যুক্তিবিরোধী আত্মসমর্পণ** — যেখানে মানুষ অজানাকে ঈশ্বর জ্ঞান বলে মানে, অথচ কখনো প্রশ্ন করতে শেখে না। এ ফ্যালাসি বাস্তব সমস্যাগুলো (যেমন: উত্তরাধিকার আইন, কসমোলজি, নারীর অধিকার, যুদ্ধনীতি ইত্যাদি) ধামাচাপা দেয় “আল্লাহর ইচ্ছা” বলে।



মুক্তির পথ কী?


👉 “আল্লাহ জানেন” বলাটা উত্তর নয়।

👉 “আমি জানি না, কিন্তু যাচাই করবো”—এই মনোভাবই মুক্তির পথ।


একজন চিন্তাশীল মানুষ কুরআনের আয়াত হোক বা অন্য যেকোনো ধর্মগ্রন্থ—সবকিছুকে প্রশ্ন করতে জানে। কারণ, সত্য কখনো ভয় পায় না প্রশ্নকে, বরং শক্তি নেয় সংশয়ের ভেতর থেকেই।




"আল্লাহর ফ্যালাসি" হলো আমাদের যুক্তিহীনতার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। এ থেকে মুক্ত হতে হলে, আল্লাহ নয়—যুক্তি, প্রমাণ, ন্যায়ের দিকে ফিরে যেতে হবে।


তবে হ্যাঁ, এই পথে হাঁটতে গেলে একঘরে হতে হবে, প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।


কিন্তু তাও, এটিই হলো—**মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সবচেয়ে সৎ ও সাহসী পথ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন