ভূমিকা: যুক্তি, চিন্তা ও বিশ্বাস
মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ আধ্যাত্মিক প্রশ্ন করেছে—কে আমি? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাচ্ছি? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের ধারা। ধর্ম বহু মানুষের জীবনে শান্তি এনেছে, আবার ধর্মান্ধতা বহু মানুষের জীবনে এনেছে অশান্তি, যুদ্ধ ও নিপীড়ন। অন্যদিকে নাস্তিকতা—যা অনেকের কাছে কেবল অবিশ্বাস নয়, বরং যুক্তির নিরপেক্ষ চর্চা—ধর্মান্ধতার বিপরীতে এক মানবিক মুক্তির পথ হতে পারে।
এই বইয়ের উদ্দেশ্য হলো ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ নয়, বরং ধর্মান্ধতার বিপক্ষে যুক্তিসম্মত, মানবিক ও দর্শনভিত্তিক অবস্থান তুলে ধরা। এখানে নাস্তিকতাকে দেখানো হবে এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে, যা যুক্তি, প্রমাণ ও স্বাধীন চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়।
অধ্যায় ১: ধর্মান্ধতা — সংজ্ঞা, উদাহরণ ও ফলাফল
ধর্মান্ধতা শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল ব্যবহৃত, কিন্তু সবসময় এর প্রকৃত অর্থ সবার কাছে পরিষ্কার নয়। সাধারণভাবে, ধর্মান্ধতা বলতে বোঝায় ধর্মীয় বিশ্বাসকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরা, যেখানে যুক্তি, সহনশীলতা ও ভিন্নমতের প্রতি সম্মান অনুপস্থিত থাকে। এটি এক ধরনের বদ্ধধারণা, যেখানে "আমার বিশ্বাসই সত্য, বাকিরা মিথ্যা" — এই মনোভাব কেন্দ্রে থাকে।
১.১ ধর্মান্ধতা ও ধর্মচর্চার পার্থক্য
ধর্মান্ধতা ধর্মচর্চার সমার্থক নয়। একজন মানুষ ধর্ম পালন করতেই পারে—তার প্রার্থনা, উপাসনা, রীতিনীতি থাকতে পারে। কিন্তু যখন সেই ধর্মীয় বিশ্বাস তাকে সহিংস করে তোলে, তাকে অন্যদের বিশ্বাসের প্রতি ঘৃণিত বা সহিষ্ণুতাবিহীন করে তোলে, তখন সেটা ধর্মান্ধতার রূপ নেয়।
ধর্মচর্চা ব্যক্তিগত, আত্মিক উন্নয়নের পথ হতে পারে, কিন্তু ধর্মান্ধতা ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের পরিপন্থী হয়।
১.২ ধর্মান্ধতার বাস্তব উদাহরণ
ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত: মধ্যযুগে ইউরোপে গ্যালিলিওকে গ্রহ-নক্ষত্রের গঠন নিয়ে সত্য বলার জন্য শাস্তি পেতে হয়েছিল, কারণ তার আবিষ্কার ধর্মীয় মতবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপট: বিভিন্ন দেশে আজও ধর্ম অবমাননার নামে মানুষকে হত্যা করা হয়, লেখক ও চিন্তাবিদরা গলা টিপে ধরার হুমকির মুখে পড়েন, স্কুলে বিজ্ঞানের পাঠে ধর্মীয় সেন্সর চলে।
১.৩ ধর্মান্ধতার ফলাফল
সহিংসতা: ধর্মান্ধতা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠলে দাঙ্গা, সন্ত্রাস ও যুদ্ধ হয়।
চিন্তাচর্চার পতন: ধর্মান্ধতা মানুষকে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে নতুন চিন্তা, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বাধা পায়।
ভিন্নমতের দমন: লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী কিংবা সাধারণ মানুষ—যারা ভিন্ন কিছু বলতে চান, তারা হয় নিষিদ্ধ হন, হয়তো জীবন হারান।
১.৪ ধর্মান্ধতার মনস্তত্ত্ব
ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা সাধারণত ভয়, অপরাধবোধ বা স্বর্গ-নরকের তত্ত্বে এতটাই আবদ্ধ থাকেন যে, তারা যুক্তিকে ভয় পান। তাদের বিশ্বাস ভেঙে পড়লে যেন তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন—এই ভীতি থেকেই তারা একরকম আত্মরক্ষামূলক আগ্রাসী মনোভাব গ্রহণ করেন।
অধ্যায় ২: নাস্তিকতা কী ও কী নয়
নাস্তিকতা শব্দটি ঘিরে সমাজে নানা ভুল ধারণা রয়েছে। কেউ ভাবেন নাস্তিক মানেই ধর্মবিদ্বেষী, কেউ বলেন নাস্তিক মানেই নৈতিকতাবিহীন, আবার কেউ মনে করেন নাস্তিকরা শুধু "অবিশ্বাসী" — কিন্তু বাস্তবতা হলো, নাস্তিকতা একটি চিন্তাধারা, যা যুক্তি, প্রমাণ ও প্রশ্ন করার অধিকারকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
২.১ নাস্তিকতার সংজ্ঞা
নাস্তিকতা হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে একজন ব্যক্তি কোনো ঈশ্বর, স্রষ্টা বা অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, কারণ তিনি মনে করেন এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
একজন নাস্তিক বলতেই পারেন:
"আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কারণ প্রমাণ পাই না।"
"আমি এমন কোনো কিছুর উপাসনা করি না, যার অস্তিত্ব যাচাই করা যায় না।"
"নৈতিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ ধর্ম ছাড়াও সম্ভব।"
২.২ নাস্তিকতা কী নয়
নাস্তিকতা ধর্মবিদ্বেষ নয়: একজন নাস্তিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বাসের বিরোধিতা করলেও, সেটা ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যক্তিগত আস্থার প্রতি ঘৃণা নয়। বরং, সমালোচনা হয় চিন্তাগত।
নাস্তিকতা অপসংস্কৃতি নয়: অনেকেই মনে করেন নাস্তিক মানেই চরিত্রহীন, বেপরোয়া জীবনযাপনকারী। কিন্তু ইতিহাসে বহু নাস্তিক ব্যক্তি ছিলেন নীতিবান, মানবতাবাদী এবং সমাজের পথপ্রদর্শক।
নাস্তিক মানেই নিশ্চিতভাবে জানে ‘ঈশ্বর নেই’ — এমন নয়: কেউ কেউ নিজেদের অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করেন, অর্থাৎ তারা বলেন—“আমি জানি না ঈশ্বর আছে কিনা, তবে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করব না।”
২.৩ নাস্তিকতা একটি দার্শনিক অবস্থান
নাস্তিকতা কেবল ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস নয়, এটি একটি দার্শনিক বোধ। এখানে ব্যক্তি নিজেকে জবাবদিহিমূলক মনে করে, ঈশ্বর বা ধর্মের কাছে নয়। তার নৈতিকতার ভিত্তি হয় মানবিকতা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও যুক্তি।
২.৪ বিশ্বের প্রভাবশালী নাস্তিক চিন্তাবিদ
বারট্রান্ড রাসেল — যুক্তি ও নৈতিকতা বিষয়ে তার লেখায় নাস্তিকতার সংজ্ঞা পরিষ্কার।
রিচার্ড ডকিন্স — "The God Delusion" গ্রন্থে ধর্ম ও ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ অবস্থান।
কার্ল সেগান — বিজ্ঞান ও স্কেপটিসিজমকে কেন্দ্র করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ডেভিড হিউম — ধর্মীয় বিশ্বাস ও অলৌকিকতা বিষয়ে গভীর দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
অধ্যায় ৩: বিশ্বাস বনাম যুক্তির দ্বন্দ্ব
বিশ্বাস ও যুক্তি—এই দুটি ধারণা মানুষের চিন্তাজগতে যুগ যুগ ধরে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে বিশ্বাস মানুষকে সান্ত্বনা দেয়, অপরদিকে যুক্তি মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব, বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে পার্থক্য কী, কেন এই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, এবং নাস্তিকতা কেন যুক্তির পথকে অগ্রাধিকার দেয়।
৩.১ বিশ্বাস কী?
বিশ্বাস এমন একটি মানসিক অবস্থা যা প্রমাণ ছাড়াও ধারণা তৈরি করে। অনেক সময় এই বিশ্বাস জন্মায় পরিবার, সংস্কৃতি বা সমাজের প্রভাবে। উদাহরণস্বরূপ:
ঈশ্বর সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।
মৃত্যুর পর জীবন আছে।
কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি পালন করলে পরকাল শুভ হবে।
এই বিশ্বাসগুলো অনেক মানুষের জীবনে শান্তি আনে, কিন্তু প্রশ্ন করলে অনেকেই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।
৩.২ যুক্তি কী?
যুক্তি হলো এমন একটি পদ্ধতি যা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রমাণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। যুক্তি প্রশ্ন করতে শেখায়, যেমন:
ঈশ্বর আছেন—এর কী প্রমাণ?
মৃত্যুর পর কী হয়—তা জানি কীভাবে?
কেন একটি বিশেষ ধর্মই ‘সত্য’?
যুক্তিভিত্তিক চিন্তা বিজ্ঞান, দর্শন ও নৈতিকতা গঠনে মূল চালিকাশক্তি।
৩.৩ দ্বন্দ্ব কোথায়?
বিশ্বাস মানুষকে বলে—"তুমি প্রশ্ন করো না, মেনে চলো।"
যুক্তি মানুষকে বলে—"তুমি প্রশ্ন করো, যাচাই করো।"
এই দ্বৈরথ তখন বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশ্বাসকে রক্ষার নামে প্রশ্নকেই ‘পাপ’ হিসেবে ঘোষণা করে।
৩.৪ নাস্তিকতা কেন যুক্তির পক্ষে দাঁড়ায়?
নাস্তিকতা বলে: “যা আমি জানি না, তা জানি না বলেই স্বীকার করব। প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করব না।”
এই অবস্থান ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এটি অন্ধ অনুসরণ নয়, বরং আত্মবিশ্লেষণ ও মুক্তচিন্তার ফল।
৩.৫ একটি বাস্তব উদাহরণ: সূর্যগ্রহণ
ধর্মান্ধ বিশ্বাস: সূর্যগ্রহণ হয় দেবতা রুষ্ট হলে।
যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা: সূর্যগ্রহণ হলো চন্দ্র ও সূর্যের কক্ষপথে চলাচলের কারণে তৈরি এক প্রাকৃতিক ঘটনা।
এই পার্থক্যই দেখায়—বিশ্বাস ও যুক্তির পথে হাঁটার ফল কতটা ভিন্ন হতে পারে।
অধ্যায় ৪: ধর্মান্ধতার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপদ
ধর্ম যদি মানুষের নৈতিক উন্নয়ন, আত্মিক শান্তি ও সহানুভূতির উৎস হয়—তবে ধর্মান্ধতা হলো সেই ধর্মের বিকৃত প্রতিচ্ছবি, যা সমাজে বিভাজন, সহিংসতা ও নিপীড়নের জন্ম দেয়। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব, কীভাবে ধর্মান্ধতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
---
৪.১ ধর্মান্ধতা: এক ব্যক্তিগত ঘেরাটোপের শুরু, সামাজিক অশান্তির পরিণতি
ধর্মান্ধতা প্রথমে জন্ম নেয় ব্যক্তির মনে, যেখানে সে মনে করে—তার ধর্মই একমাত্র সত্য, বাকিরা মিথ্যা বা ভ্রান্ত। এই মনোভাব ধীরে ধীরে বিস্তার পেয়ে সমাজে ঘৃণা, হিংসা ও বিভাজনের জন্ম দেয়। একসময় তা দল, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় নীতিতেও জায়গা করে নেয়।
---
৪.২ সামাজিক বিপদ:
ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব: ধর্মান্ধ সমাজে ভিন্নমতের মানুষকে অবিশ্বাসী, কাফের, মুশরিক ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে সমাজচ্যুত করা হয়।
নারী ও সংখ্যালঘু নির্যাতন: ধর্মীয় ব্যাখ্যা ব্যবহার করে নারীর অধিকার খর্ব করা হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলে।
শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রতি অবজ্ঞা: ধর্মান্ধ মানসিকতা আধুনিক শিক্ষা, যুক্তিভিত্তিক চিন্তা ও বিজ্ঞানকে হুমকি মনে করে।
ঘৃণা ও সহিংসতার সংস্কৃতি: যারা বিশ্বাস করে না বা সমালোচনা করে—তাদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণকে ধর্মীয় দায় হিসেবে দেখা হয়।
---
৪.৩ রাজনৈতিক বিপদ:
ধর্মের নামে রাজনীতি: ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা রাজনীতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে চায় এবং ধর্মকে পুঁজি করে জনমত গঠনের চেষ্টা করে।
রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘু নিপীড়ন: ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার হরণ করতে পারে, যেমন শিক্ষা, চাকরি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
আইনের অপব্যবহার: ধর্ম অবমাননা আইন, ব্লাসফেমি আইন ইত্যাদি অনেক দেশে স্বাধীন চিন্তা দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
---
৪.৪ কিছু বাস্তব উদাহরণ:
পাকিস্তান ও ব্লাসফেমি আইন: এখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়—কখনো প্রমাণ ছাড়াও।
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা: মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যা করা হয়েছে ‘ধর্ম অবমাননা’র অজুহাতে।
ভারতে গরু হত্যার সন্দেহে গণপিটুনি: নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের নামে হত্যা বৈধ করে ফেলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
---
৪.৫ ধর্মান্ধতা রাষ্ট্র ও সমাজকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
অসহিষ্ণু রাষ্ট্র গড়ে উঠে, যেখানে মতপ্রকাশ সম্ভব নয়।
প্রযুক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি থেমে যায়।
আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।
অস্থিরতা ও সহিংসতায় সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
---
এই অধ্যায় থেকে বোঝা যায়—ধর্মান্ধতা কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং তা একটি বিস্তৃত সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাধি। এটি মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন মুক্তচিন্তা, শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধ।
অধ্যায় ৫: নাস্তিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ
প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো—ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা থাকে না, ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে মানুষ ভালো হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মানবিক মূল্যবোধের উৎস কেবল ধর্ম নয়। নাস্তিকতাও মানুষকে নৈতিক, মানবিক এবং দায়িত্ববান হতে শেখাতে পারে। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব, কীভাবে নাস্তিকতা মানবিকতা এবং মূল্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
---
৫.১ মানবিক মূল্যবোধ কী?
মানবিক মূল্যবোধ হলো সেই নীতি ও আচরণ, যা একজন মানুষকে অন্যের প্রতি দায়িত্ববান, সহানুভূতিশীল ও ন্যায়নিষ্ঠ করে তোলে। যেমন:
অন্যের কষ্ট বোঝা ও সাহায্য করা
মিথ্যা না বলা
সহিংসতা না করা
নারীর প্রতি সম্মান
শিশুদের সুরক্ষা
দুর্নীতির বিরোধিতা
প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতা
এই গুণগুলো মানুষ ধর্ম ছাড়াও ধারণ করতে পারে, এবং অনেক সময় ধর্ম ছাড়াই আরও বিশুদ্ধভাবে পালন করতে পারে।
---
৫.২ নাস্তিকতা কীভাবে নৈতিক হতে শেখায়?
দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়: নাস্তিক ব্যক্তি বলে—“আমার কাজের জন্য আমি দায়ী, কোনো ঈশ্বরের ইচ্ছা বা পরীক্ষার কথা বলে দায় এড়াতে পারি না।”
ভয়ের নৈতিকতা নয়, যুক্তির নৈতিকতা: নাস্তিক নৈতিকভাবে ভালো থাকেন ভয় থেকে নয়, বরং এটা বিশ্বাস থেকে যে ভালো কাজ মানুষকে মানুষ করে তোলে।
সহানুভূতি, ন্যায্যতা ও স্বাধীনতা: এসব গুণ যুক্তিবাদী চিন্তার মাধ্যমে অর্জিত হয়, যেগুলো নাস্তিকতাও লালন করে।
---
৫.৩ ধর্মান্ধ নৈতিকতা বনাম মানবিক নৈতিকতা
---
৫.৪ বাস্তব উদাহরণ: নাস্তিকদের মানবিক উদ্যোগ
পেনসিলভানিয়ার “Recovering from Religion” সংগঠন—মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের সহায়তা করে, ধর্মীয় ভয়ের বাইরে গিয়ে।
Richard Dawkins Foundation—বিজ্ঞানের প্রচার ও মানবিক কাজ করে, ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে।
অ্যানি লরি গেইলর ও ড্যান বার্কার—Freedom From Religion Foundation এর মাধ্যমে মানবাধিকার ও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন।
---
৫.৫ নৈতিকতা কি সত্যিই ঈশ্বর ছাড়া সম্ভব?
এই প্রশ্ন বহুদিনের। কিন্তু নাস্তিকেরা উত্তর দেন—নৈতিকতা হলো বিবর্তনের ফল, সামাজিক চুক্তির ভিত্তি, এবং সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা। এটি কোনো অলৌকিক উৎসের ওপর নির্ভরশীল নয়।
---
এই অধ্যায়ে বোঝা গেল যে, নাস্তিকতা কেবল অবিশ্বাস নয়, বরং তা একটি মানবিক ও দায়িত্বশীল অবস্থানও হতে পারে। পরবর্তী অধ্যায় “বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মান্ধতা ও নাস্তিকতার সম্পর্ক
অধ্যায় ৬: বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মান্ধতা ও নাস্তিকতার সম্পর্ক
বিজ্ঞান হলো জ্ঞানের এমন একটি শাখা, যা পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও প্রমাণের মাধ্যমে সত্য খুঁজে বের করে। এই প্রক্রিয়া যুক্তিবাদী চিন্তার ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, ধর্মান্ধতা প্রায়শই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে, কারণ এটি বিশ্বাস-নির্ভর। আর নাস্তিকতা, বিজ্ঞান ও যুক্তিকে মেনে চলে বলে, এটি বিজ্ঞানের প্রাকৃতিক মিত্র। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব—ধর্মান্ধতা ও নাস্তিকতা কীভাবে বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে বা ভেঙে ফেলে।
---
৬.১ বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে?
বিজ্ঞান প্রশ্ন করে, পরীক্ষা করে, ভুল ধরিয়ে দেয়, এবং প্রয়োজনে পুরনো ধারণাকেও বাতিল করে। বিজ্ঞান বলে:
"যদি প্রমাণ থাকে, তবে বিশ্বাস করো।"
"নতুন তথ্য পেলে আগের ধারণা বদলাও।"
"কোনো দাবি সত্য কি না, তা যাচাই করো।"
এমন দৃষ্টিভঙ্গি কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ায় না—এটি সত্যের খোঁজে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান।
---
৬.২ ধর্মান্ধতার সঙ্গে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব
বিশ্বাসের অন্ধ অনুসরণ: ধর্মান্ধ ব্যক্তি মনে করে—যা ধর্মগ্রন্থে আছে, তা প্রশ্নাতীত সত্য। ফলে বিজ্ঞান যখন ভিন্ন কিছু বলে, তখন সেটা “ঈমানের বিরুদ্ধে” মনে হয়।
প্রাকৃতিক ঘটনার অলৌকিক ব্যাখ্যা: ভূমিকম্প, বন্যা, রোগ—এসবকে অনেক সময় ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে বিজ্ঞান খুঁজে পায় প্রকৃত কারণ।
বিজ্ঞানের বইতে সেন্সর: অনেক দেশেই ধর্মান্ধতার কারণে জীববিজ্ঞান বা মহাকাশবিজ্ঞানের পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হয়, যেমন ডারউইনের বিবর্তনবাদ সরিয়ে দেওয়া।
---
৬.৩ নাস্তিকতা ও বিজ্ঞান: পারস্পরিক সম্পর্ক
যুক্তি ও প্রমাণে বিশ্বাস: নাস্তিকতা বলে—“যা প্রমাণ নেই, তা আমি বিশ্বাস করি না।” এই অবস্থান সরাসরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পরিবর্তন স্বীকারের মানসিকতা: বিজ্ঞান যেমন পুরনো ধারণা পরিত্যাগ করে, নাস্তিকতাও আগল ধরে রাখে না—বরং প্রশ্ন করতে শেখায়।
জ্ঞানানুসন্ধানের স্বাধীনতা: নাস্তিকতার দর্শন গবেষণা, প্রশ্ন ও চিন্তার স্বাধীনতাকে উৎসাহ দেয়, যা বিজ্ঞান চর্চার জন্য অপরিহার্য।
---
৬.৪ ইতিহাসে ধর্মান্ধতা বনাম বিজ্ঞান: কিছু ঘটনা
গ্যালিলিও গ্যালিলি: তিনি সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বলায় চার্চের রোষানলে পড়েন।
চার্লস ডারউইন: বিবর্তনবাদ ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীতে যাওয়ায় বহু বিতর্কের মুখে পড়েন।
মধ্যযুগীয় ইউরোপ: “ডার্ক এইজ” নামে পরিচিত এই সময়কাল ধর্মীয় কর্তৃত্বে বিজ্ঞানের বিকাশ রুদ্ধ করে দেয়।
---
৬.৫ আজকের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের গুরুত্ব
কোভিড-১৯ মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞানহীন সমাজ কতটা বিপদে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিজ্ঞানই একমাত্র পথনির্দেশক।
চিকিৎসা, প্রযুক্তি, যোগাযোগ—সব কিছুতেই বিজ্ঞান নির্ভরতা তৈরি করেছে, যা অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে সম্ভব নয়।
---
এই অধ্যায়ে পরিষ্কার বোঝা যায়, ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞান পরস্পরবিরোধী, আর নাস্তিকতা ও বিভবিষ্যতেরজ্ঞান পরস্পরের সহচর। বিজ্ঞান আমাদের মুক্ত করে কুসংস্কার থেকে—আর নাস্তিকতা আমাদের সাহস দেয় প্রশ্ন করার।
অধ্যায় ৭: পৃথিবী: ধর্মান্ধতা না মুক্তচিন্তা?
পৃথিবী এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—একদিকে ধর্মীয় উগ্রতা, সহিংসতা, গোঁড়ামি; অন্যদিকে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনন ও মানবতাবাদ। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের রূপরেখা। প্রশ্ন হলো, আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? ধর্মান্ধতার অন্ধকার, না কি যুক্তির আলো?
---
৭.১ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে ধর্মান্ধতার সংঘাত
মানবজাতি এখন মহাকাশ জয় করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করছে, জিন সম্পাদনা করছে। অথচ এই যুগেও কেউ কেউ বিশ্বাস করছে:
সূর্যগ্রহণ হলো পাপের ফল।
নারীর উচ্চশিক্ষা হারাম।
চিকিৎসা নয়, তাবিজ-কবচেই রোগ সারবে।
এই সাংঘর্ষিক বাস্তবতা এক অসুস্থ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়—যেখানে প্রযুক্তি থাকবে, কিন্তু মন থাকবে প্রাচীনতায় বন্দি।
---
৭.২ মুক্তচিন্তার সম্ভাবনা
মুক্তচিন্তা মানে যা খুশি বলা নয়, বরং যুক্তিনির্ভর ও মানবিক চিন্তা। মুক্তচিন্তা:
মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা করে।
সত্যের সন্ধান করে—যার উৎস হতে পারে বিজ্ঞান, দর্শন, কিংবা অভিজ্ঞতা।
সমাজকে গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ও সহানুভূতিশীল করে।
যে সমাজ মুক্তচিন্তা চর্চা করে, সেখানে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবতা একত্রে বিকশিত হয়।
---
৭.৩ ধর্মান্ধতা ও চরমপন্থার বিপদ
সমাজে দাঙ্গা, গণহত্যা ও বিভাজনের মূল কারণ অনেক সময় ধর্মান্ধতা।
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন ধর্মের রং মাখে, তখন সংখ্যালঘুদের অধিকার বিপন্ন হয়।
পরিণামে শান্তি নয়, স্থবিরতা ও সংকীর্ণতা সমাজকে গ্রাস করে।
---
৭.৪ ভবিষ্যৎ কোন পথে?
ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের আজকের সিদ্ধান্তের ওপর:
আমরা কি আমাদের সন্তানদের যুক্তি শেখাব, না কেবল ধর্মীয় ভয়?
আমরা কি শিক্ষায় বিজ্ঞান ও মানবতা ঢোকাব, না কুসংস্কার ও বিভাজন?
আমরা কি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখব, না ধর্মভিত্তিক রাজনীতির খেলায় ঢুকব?
যদি উত্তর হয় যুক্তি, মানবতা ও স্বাধীনতা—তবে ভবিষ্যৎ হবে মুক্তচিন্তার, উদারতার, সহানুভূতির। আর যদি উত্তর হয় ভয়, শাস্তি ও বিশ্বাসের নামে নিপীড়ন—তবে তা হবে ধর্মান্ধতার জিঞ্জিরে বাঁধা এক অন্ধ ভবিষ্যৎ।
---
শেষ কথা: কেন নাস্তিকতা ধর্মান্ধতা থেকে ভালো
নাস্তিকতা অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং প্রশ্ন করার সাহস। এটি কাউকে অনুসরণ নয়, বরং নিজে চিন্তা করার অনুশীলন।
নাস্তিকতা বিশ্বাস করে—সত্য বড়, না যে তা প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে কি না।
এই বিশ্বাসের জোরেই নাস্তিকতা ধর্মান্ধতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য, যুক্তি ও মানবতার পক্ষে কথা বলে।