অনেক মুসলিম বিশ্বাস করে যে, মরিস বুকাইলি (Maurice Bucaille) যখন মিশরের মমি পরীক্ষা করছিলেন, তখন তিনি আবিষ্কার করেন যে, এটি সেই ফেরাউনের মমি, যিনি নবী মূসার (Moses) সময়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। এই দাবির ভিত্তিতে বলা হয়, মরিস বুকাইলি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ফারাও কে ছিলেন?
মিশরের ইতিহাসে "ফারাও" ছিল শাসকদের উপাধি। কিন্তু কুরআন ও বাইবেলে উল্লেখিত ফেরাউন কে ছিলেন, তা নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। যেহেতু বাইবেল ও কুরআনের বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে অস্পষ্ট, তাই সঠিকভাবে বলা কঠিন যে, নবী মূসার সময়কার ফেরাউন কে ছিলেন। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন, কুরআনে এবং বাইবেলে বর্ণিত ফেরাউন সম্ভবত রামসেস II (Ramesses II) অথবা তার পুত্র মেরেনপ্তাহ (Merneptah) হতে পারেন।
কেন মেরেনপ্তাহকে মূসার ফেরাউন বলে ধরা হয়?
প্রধানত দুটি কারণ:
1. Merneptah Stele (মেরেনপ্তাহ শিলালিপি) – এটি একটি প্রাচীন শিলালিপি যেখানে "ইসরায়েল" শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। মেরেনপ্তাহ শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে, মেরেনপ্তাহ ইসরায়েলিদের (Hebrews) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
2. মেরেনপ্তাহের মমি সংরক্ষিত আছে – কুরআনে বলা হয়েছে, ফেরাউনকে আল্লাহ শাস্তি দিয়েছেন, তবে তার দেহকে সংরক্ষণ করেছেন। অনেক মুসলিম দাবি করেন, মেরেনপ্তাহের সংরক্ষিত মমি এর প্রমাণ।
তবে এখানে কিছু বড় সমস্যা আছে:
মেরেনপ্তাহের মমি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তিনি পানিতে ডুবে মারা যাননি; বরং স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
প্রাচীন মিশরের রেকর্ড অনুযায়ী, রামসেস II ও মেরেনপ্তাহ কেউই সাগরে ডুবে মারা যাননি।
মরিস বুকাইলির গবেষণা বৈজ্ঞানিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ, এবং তার দাবিগুলোকে মূলধারার ইতিহাসবিদরা গ্রহণ করেননি।
সুতরাং, যে বিশ্বাসটি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, মরিস বুকাইলি এই আবিষ্কার করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং নবী মূসার ফেরাউন পানিতে ডুবে গিয়েছিল—তা ইতিহাস ও বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত নয়।
ফেরাউন কি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল?
অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন যে, ফেরাউন পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল এবং আল্লাহ তার দেহ সংরক্ষণ করে রেখেছেন, যা আজকের মিশরের মমির মধ্যে বিদ্যমান। কুরআনের একটি আয়াতকে এই দাবির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়:
“আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব, যেন তুমি তোমার পরবর্তী লোকদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকতে পারো। কিন্তু মানুষের অনেকেই আমার নিদর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ।” (সূরা ইউনুস 10:92)
কিন্তু ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আরও বিশ্লেষণ করা দরকার।
বাইবেল ও কুরআনের ফেরাউনের মৃত্যু: মিল-অমিল
কুরআন: কুরআন অনুযায়ী, ফেরাউন তার বিশাল বাহিনী নিয়ে মূসা (আ.) ও তার অনুসারীদের পেছনে ধাওয়া করে। আল্লাহ সমুদ্রকে দুই ভাগ করে দেন এবং মূসার অনুসারীরা নিরাপদে পার হয়ে যান। কিন্তু ফেরাউন যখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ে, তখন সমুদ্র আবার মিলিত হয়ে যায় এবং ফেরাউনসহ তার সৈন্যবাহিনী ডুবে যায়।
বাইবেল: বাইবেলের Exodus 14:28-এ বলা হয়েছে, “সমুদ্র ফিরে এলো এবং ফেরাউনের সম্পূর্ণ বাহিনী ডুবে গেল। একটিও রক্ষা পায়নি।” তবে বাইবেলে কোথাও বলা হয়নি যে, ফেরাউনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব কী বলে?
কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই: মিশরের ইতিহাসে কোনো ফেরাউনের সমুদ্রগামী বাহিনীসহ নিখোঁজ হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। মিশরের রাজার মৃত্যুর ঘটনা সাধারণত বিশদভাবে নথিভুক্ত করা হতো, কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, কোনো ফেরাউন সাগরে ডুবে মারা গেছেন।
মেরেনপ্তাহের মমি: যাকে অনেক মুসলমান নবী মূসার ফেরাউন বলে মনে করেন, তার মমি পাওয়া গেছে এবং পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, তিনি ডুবে মারা যাননি, বরং বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন।
রামসেস II-এর মমি: অনেক মুসলমান দাবি করেন, রামসেস II নবী মূসার সময়কার ফেরাউন ছিলেন এবং তার দেহই সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন, রামসেস II স্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছিলেন এবং তার শরীরে পানিতে ডুবে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কী?
1. কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ভুল হতে পারে: কুরআনে বলা হয়েছে যে, ফেরাউনের দেহ সংরক্ষণ করা হবে, তবে তা সরাসরি মমির বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় কিনা, তা নিশ্চিত নয়। হতে পারে, এটি কেবল একটি প্রতীকী বক্তব্য।
2. ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাটি কিংবদন্তি: ইতিহাসে অনেকবার দেখা গেছে, ধর্মীয় গ্রন্থে কিছু ঘটনা অতিরঞ্জিত হয়ে যায় বা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। ফেরাউনের সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়া এমন একটি ঘটনা হতে পারে।
সুতরাং, ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, ফেরাউন সম্ভবত পানিতে ডুবে মারা যাননি। এটি কেবল ধর্মীয় কাহিনির অংশ হতে পারে, বাস্তব ইতিহাস নয়।
মূসা নামের কারো কি অস্তিত্ব ছিল?
বাইবেল ও কুরআনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মূসা (Moses বা Musa)। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি ইহুদিদের নেতা ছিলেন এবং তাদের মিশর থেকে উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আসলেই কি মূসা নামে কেউ ইতিহাসে ছিলেন? নাকি এটি একটি ধর্মীয় কাহিনি মাত্র?
প্রাচীন মিশরের রেকর্ডে মূসার নাম নেই
মিশর ছিল একটি অত্যন্ত সংগঠিত সভ্যতা, যেখানে প্রতিটি শাসকের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হতো। রাজাদের রাজত্ব, যুদ্ধ, জয়-পরাজয়, এমনকি প্রশাসনিক বিষয়গুলিও তারা পাথরের ফলকে খোদাই করে রাখত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মিশরীয় লিপিতে মূসা নামের কোনো ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
Exodus (নির্গমন) কাহিনির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই: বাইবেলের Exodus অধ্যায়ে বলা হয়েছে, মূসা ইসরায়েলিদের মিশর থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মিশরের কোনো ঐতিহাসিক নথিতে এই ঘটনার উল্লেখ নেই।
দাসপ্রথার তথ্যবিরোধিতা: বাইবেল অনুসারে, ইহুদিরা মিশরে দাস ছিল। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, মিশরে ইহুদিদের দাসত্বের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
মূসা নামের উৎপত্তি কী?
মিশরীয় ভাষায় "Moses" (মূসা) শব্দটির অর্থ হলো "সন্তান" বা "উদ্ধারপ্রাপ্ত ব্যক্তি"। উদাহরণস্বরূপ:
Tutmosis (তুতমোসিস) = ঈশ্বর থোতের সন্তান
Ramesses (রামেসিস) = ঈশ্বর রা-এর সন্তান
তাহলে, "মূসা" কি কোনো বাস্তব চরিত্র ছিলেন, নাকি এটি মিশরীয় নামকরণের একটি ভুল ব্যাখ্যা? কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, মূসা নামটি হয়তো কোনো মিশরীয় প্রভাবিত ইহুদি কাহিনি থেকে এসেছে, কিন্তু এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়।
পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় মূসার অস্তিত্ব নেই
বিশ্বের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক মিশর এবং সিনাই মরুভূমিতে গবেষণা চালিয়েছে, যেখানে মূসার নেতৃত্বে ইহুদিরা ৪০ বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু:
সিনাই মরুভূমিতে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাসের কোনো প্রমাণ নেই।
কোনো প্রাচীন শিলালিপি বা মূর্তি পাওয়া যায়নি, যেখানে মূসার কথা উল্লেখ রয়েছে।
Exodus-এর কাহিনি কোনো প্রাচীন মিশরীয় নথিতে পাওয়া যায়নি।
সম্ভাব্য ব্যাখ্যা কী?
1. মূসা একটি কিংবদন্তি চরিত্র: মূসার গল্প হয়তো সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক, যা ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় গঠনের জন্য তৈরি করেছে।
2. মূসার কাহিনি হয়তো প্রকৃত ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি, কিন্তু অতিরঞ্জিত: হয়তো মিশর থেকে কিছু ইহুদি ক্রীতদাস পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেটাকে পরে অতিরঞ্জিত করে বিশাল কাহিনিতে পরিণত করা হয়েছে।
3. বাইবেলের Exodus সম্ভবত রাজনৈতিক উপাখ্যান: অনেক গবেষক মনে করেন, ইহুদিরা নিজেদের জাতিগত ঐতিহ্য গড়ার জন্য Exodus-এর গল্প তৈরি করেছে, যাতে তারা নিজেদের "ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি" হিসেবে পরিচিত করতে পারে।
ফলাফল
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, মূসা নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। এটি সম্ভবত একটি ধর্মীয় কাহিনি, যা ঐতিহাসিক সত্য নয়।
মরিস বুকাইলির ইসলাম গ্রহণের দাবির সত্যতা
অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন যে, ফরাসি চিকিৎসক এবং লেখক মরিস বুকাইলি (Maurice Bucaille) ইসলাম গবেষণা করতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মূলত, তার লেখা বই “The Bible, The Qur'an and Science” ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়, যা এই দাবির ভিত্তি গড়ে তোলে। কিন্তু আসল সত্য কী?
কে ছিলেন মরিস বুকাইলি?
মরিস বুকাইলি (১৯২০-১৯৯৮) ছিলেন একজন ফরাসি চিকিৎসক, যিনি সৌদি রাজপরিবার এবং মিশরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির চিকিৎসক ছিলেন।
তিনি ১৯৭৬ সালে “The Bible, The Qur'an and Science” বইটি লেখেন, যেখানে তিনি দাবি করেন যে, কুরআনের অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মুসলিম বিশ্বে তার বই ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং অনেক মুসলমান মনে করতে শুরু করেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
বুকাইলি কি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন?
এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি দাবি। মরিস বুকাইলি কখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তার কোনো জীবনী বা প্রামাণ্য তথ্য এই দাবিকে সমর্থন করে না।
বুকাইলি তার জীবদ্দশায় একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং তিনি একজন "ধর্মনিরপেক্ষ ক্যাথলিক" ছিলেন।
তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কখনো বলেননি যে, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন।
১৯৯৮ সালে মৃত্যুর পর তার খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যা প্রমাণ করে যে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি।
কীভাবে এই গুজব ছড়াল?
মরিস বুকাইলির বই মুসলিম বিশ্বে এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, অনেক মুসলমান মনে করতে থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
ইসলামিক বক্তারা (বিশেষ করে জাকির নায়েকের মতো বক্তারা) বুকাইলির কথাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করেন এবং দাবি করেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
সামাজিক মাধ্যমে ভিত্তিহীন তথ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই ভুল ধারণা আরও শক্তিশালী হয়।
বুকাইলির বই নিয়ে বিতর্ক
বুকাইলির বইতে তিনি কুরআনের কিছু আয়াতকে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে দাবি করেন। কিন্তু তার বই নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা রয়েছে:
1. বিজ্ঞানকে কুরআনের সঙ্গে জোরপূর্বক মেলানোর চেষ্টা: তিনি কুরআনের কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা এমনভাবে দিয়েছেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ মনে করেন, এটি তার ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা মাত্র।
2. বাইবেলকে খাটো দেখানোর চেষ্টা: তিনি বাইবেলের বিভিন্ন অংশকে অসংগতিপূর্ণ এবং বিজ্ঞানের বিপরীত বলে দাবি করেছেন, যা অনেক খ্রিস্টান পণ্ডিত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
3. পশ্চিমা একাডেমিক দুনিয়ায় তার বই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি: পশ্চিমা একাডেমিক মহলে তার বই কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, বরং অনেক বিজ্ঞানী তার যুক্তিগুলোকে "pseudoscience" (কল্পবিজ্ঞান) এবং পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা বলে মনে করেন।
ফলাফল
মরিস বুকাইলি কখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি।
তার বই ইসলামের প্রতি ইতিবাচক হলেও, এতে অনেক অতিরঞ্জিত দাবি রয়েছে।
ইসলামিক বক্তারা তার কাজকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং মুসলমানদের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়েছেন যে, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন।
সুতরাং, “মরিস বুকাইলি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন” – এটি একটি ভিত্তিহীন গল্প মাত্র।
ফেরাউন কি আসলেই পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল?
অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, ফেরাউন লোহিত সাগরে (Red Sea) ডুবে মারা গিয়েছিল, যখন সে হজরত মূসা (আ.) ও ইসরায়েলি জাতিকে তাড়া করছিল। বাইবেল ও কুরআন দুটোতেই ফেরাউনের ডুবে যাওয়ার কাহিনি পাওয়া যায়। তবে, এই দাবির ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কতটা সত্য?
বাইবেল ও কুরআনের বিবরণ
বাইবেল (Exodus 14:28-29)
বাইবেল অনুযায়ী, মূসা (আ.) তার লাঠি দিয়ে সমুদ্র বিভক্ত করেন, এবং ইসরায়েলিরা শুকনো পথ দিয়ে পার হন।
ফেরাউন ও তার বাহিনী তাদের তাড়া করলে, পানি তাদের ওপর ভেঙে পড়ে এবং তারা সকলেই ডুবে মারা যায়।
কুরআন (সূরা ইউনুস ১০:৯০-৯২, সূরা আশ-শু'আরা ২৬:৬৫-৬৬)
কুরআনও ফেরাউনের ডুবে যাওয়ার কথা বলে, তবে একটি অতিরিক্ত তথ্য দেয়:
“আজ আমরা তোমার দেহকে রক্ষা করব, যেন তুমি তোমার পরবর্তী লোকদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো।”
এই বক্তব্যকে অনেকে রামেসিস II-এর মমির সঙ্গে যুক্ত করেন, যা ইতোমধ্যে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ
১. পানিতে ডুবে যাওয়া ফেরাউনের কোনো প্রমাণ নেই
মিশরের ইতিহাসে কোনো ফেরাউনের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কোনো উল্লেখ নেই।
সব ফেরাউনের মৃত্যুবার্ষিকী ও সমাধিস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে পাওয়া গেছে, এবং তারা সবাই প্রাকৃতিক মৃত্যু বরণ করেছেন।
২. মিশরীয় রেকর্ডে কোনো "বড় সমুদ্র বিপর্যয়" নেই
মিশরীয়দের রেকর্ড সাধারণত অনেক বিস্তারিত, কিন্তু লোহিত সাগরে পুরো সেনাবাহিনী হারানোর কোনো তথ্য নেই।
একটি এত বড় ঘটনা ঘটলে নিশ্চয়ই মিশরীয় লিপিতে এর উল্লেখ থাকত, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।
৩. ফেরাউনের সেনাবাহিনীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি
লোহিত সাগরে এত বড় সেনাবাহিনী ডুবে গেলে, তাদের অস্ত্র, যুদ্ধের রথ, এবং দেহাবশেষ পানির নিচে থাকার কথা।
কিন্তু এখন পর্যন্ত লোহিত সাগরে এমন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞান কী বলে?
১. লোহিত সাগর কি সত্যিই বিভক্ত হতে পারে?
কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেছেন যে, বিশেষ ধরনের ঝড়ের কারণে জল সরে গিয়ে সাময়িকভাবে শুকনো জমি তৈরি হতে পারে (যেমন হারিকেনের আগে কিছু উপকূলে দেখা যায়)।
তবে এটি খুব স্বল্প সময়ের জন্য হতে পারে এবং পুরো সেনাবাহিনী ডুবে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
২. ফেরাউনের মৃত্যু কীভাবে ঘটেছিল?
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, রামেসিস II, মেরেনপতাহ, বা অন্য কোনো প্রস্তাবিত ফেরাউন পানিতে ডুবে মারা যাননি।
তাদের মমিতে পানিতে ডুবে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মিশরের মমিগুলোর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তারা স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন এবং যথাযথভাবে সমাহিত হয়েছেন।
---
ফলাফল
বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিকভাবে ফেরাউনের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।
মিশরীয় ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনার রেকর্ড নেই যেখানে পুরো সেনাবাহিনী পানিতে ডুবে গেছে।
লোহিত সাগরের নিচে এমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি যা এই কাহিনিকে সমর্থন করে।
সুতরাং, “ফেরাউন পানিতে ডুবে মারা গেছে” – এটি একটি ধর্মীয় কাহিনি মাত্র, যার বাস্তবসম্মত প্রমাণ নেই।
মনুষ্যত্বের জয় হোক!
ধন্যবাদ!