তসলিমা নাসরিন: যিনি গভীরভাবে ইসলামকে আঘাত করেছেন

সূচিপত্র

১. তসলিমা নাসরিন কে? সংক্ষিপ্ত পরিচয়

তসলিমা নাসরিন একজন বাংলাদেশি লেখিকা, চিকিৎসক ও নারীবাদী। জন্ম ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট, ময়মনসিংহে। পেশায় তিনি ছিলেন গাইনি চিকিৎসক, কিন্তু পরবর্তীতে পুরোপুরি সাহিত্য ও সমাজচিন্তায় মনোনিবেশ করেন। আশির দশকের শেষদিকে ও নব্বই দশকে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস ও কলাম তাঁকে বিতর্কিত এবং একইসাথে বিখ্যাত করে তোলে।
তিনি নারীর অধিকার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সমাজের রক্ষণশীল মূল্যবোধের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁর টার্গেট হয়ে উঠে ইসলাম ধর্ম—বিশেষ করে কোরআন, হাদিস এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থা। তাঁর মতে, এগুলো নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, নিপীড়নমূলক ও অমানবিক।

২. তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা ও 'লজ্জা'

তসলিমা নাসরিনের সাহিত্যজীবন শুরু হয় কবিতা দিয়ে। আশির দশকে নারীবাদী কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে। কিন্তু মূলত গদ্য লেখার মাধ্যমেই তিনি আলোচনায় উঠে আসেন, বিশেষ করে যখন তিনি ধর্ম, যৌনতা ও নারীবাদ নিয়ে স্পষ্ট, দ্বিধাহীন ভাষায় লিখতে শুরু করেন।
‘লজ্জা’: তার সাহিত্যজীবনের মোড় ঘোরানো বই ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘লজ্জা’ তাঁকে রাতারাতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই উপন্যাসটি মূলত বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও নিপীড়নের পটভূমিতে লেখা।
তসলিমা এই বইয়ে সরাসরি দেখিয়েছেন—
কীভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ সংখ্যালঘুদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে,
ইসলামি উন্মাদনার কীভাবে ব্যবহার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়।
‘লজ্জা’ বইটি কেন এত বিতর্কিত হলো?
এ বইতে তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামের ভাবমূর্তি, মুসলিম সমাজের সহনশীলতা, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের চুপচাপ সহিংসতা মেনে নেওয়ার প্রবণতা নিয়ে। তিনি লেখেন—
“এই সমাজে সংখ্যালঘুরা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠরাই নিরাপত্তাহীন।”
এইরকম বক্তব্য শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁকে মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত করে। ‘লজ্জা’ প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

৩. ইসলাম ধর্ম নিয়ে তসলিমার অবস্থান

তসলিমা নাসরিন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ছিলেন একেবারে স্পষ্ট, খোলামেলা এবং নির্ভীক। তাঁর মতে, ইসলাম নারীকে মানুষ নয়, একধরনের “অর্ধেক মানুষ” মনে করে, আর ধর্মের নামে যেসব বিধান দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আসলে পুরুষতান্ত্রিক শাসনের হাতিয়ার।
ইসলাম ও নারীর অধিকার নিয়ে তাঁর প্রধান বক্তব্যগুলো:
নারীর উত্তরাধিকার ও সাক্ষ্যের অর্ধেক মূল্য তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছেন, একজন নারীর সাক্ষ্য বা সম্পত্তিতে কেন একজন পুরুষের চেয়ে অর্ধেক মূল্য থাকবে? এটা কি ঈশ্বরের ন্যায়বিচার হতে পারে?
হিজাব ও পর্দা ব্যবস্থা
তসলিমার মতে, ইসলামি পর্দা আসলে নারীর স্বাধীনতাকে দমন করে। তাঁর বক্তব্য:

“নারীর শরীর ঢাকা পড়ে না, নারীর কণ্ঠস্বর, স্বাধীনতা, সত্তা ঢাকা পড়ে।”
বহুবিবাহ, তালাক, ও পুরুষাধিকার
ইসলাম পুরুষদের চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়—এই বিধানকে তিনি ‘ধর্ষণের লাইসেন্স’ হিসেবে আখ্যা দেন। একইসাথে তালাকের একতরফা অধিকার ও নারীর খোলাখুলি অসম্মানকে তিনি বর্বরতা বলে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর কিছু বিখ্যাত (এবং বিতর্কিত) উক্তি:
“ধর্ম নারীকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে।”
“যে ধর্ম নারীকে মানুষ বলে না, আমি সে ধর্মের বিরুদ্ধে।”
“কোরআনে নারীকে মানুষ নয়, সম্পত্তি হিসেবে দেখা হয়েছে।”
“মুহাম্মদ কোনো আধুনিক মানুষ ছিলেন না। তিনি নিজের সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করেছেন।” এই ধরনের মন্তব্য শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নয়, এমনকি অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকেও অস্বস্তিতে ফেলে।

৪. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কোরআন ও মুহাম্মদ সম্পর্কে মন্তব্য

তসলিমা নাসরিন শুধুমাত্র ইসলামি সংস্কৃতি নয়, সরাসরি ইসলামি ধর্মগ্রন্থ কোরআন এবং প্রবর্তক মুহাম্মদ সম্পর্কেও প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। এ কারণেই তিনি শুধু সমালোচিত নন, বরং তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া পর্যন্ত জারি হয়েছে। কোরআন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি
তসলিমা কোরআনকে একটি মানব-নির্মিত দলিল বলে মনে করেন। তাঁর মতে—
কোরআন “পুরুষদের পক্ষে” লেখা হয়েছে।
এতে নারীদের বিরুদ্ধে একাধিক আইন, নির্দেশনা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
দাসপ্রথা, যুদ্ধ, যৌনদাসী এসবকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
তাঁর মতে, কোরআন “ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কিছু গোত্রের সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রচিত একধরনের আইনবিধি”—যা আধুনিক সমাজে অচল এবং অনৈতিক। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য:
তসলিমা মনে করেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো—বিশেষ করে মাদ্রাসা ও ইসলামী দলগুলো—একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও নারী-বিদ্বেষ শেখায়। তাঁর মতে:
“মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় নেতারা ধর্মের নামে মিথ্যা শেখান, মানুষকে ভয় দেখান, আর নারীদের জেলখানায় আটকে রাখতে চান।”
মুহাম্মদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য:
সবচেয়ে আলোচিত (এবং মুসলিমদের কাছে অপমানজনক) মন্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মুহাম্মদ সম্পর্কে করা কথাগুলো। তসলিমা লিখেছেন:
“মুহাম্মদ ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজের নিয়ম নিজের সুবিধামতো বদলে নিয়েছেন।”
“তিনি একাধিক বিবাহ করেছেন, এমনকি একটি শিশুকন্যাকেও (আয়েশা) বিয়ে করেছেন।”
“এ ধরনের মানুষ যদি আজ থাকতেন, তাহলে তাঁকে ধর্ষণকারী হিসেবে বিচার করা হতো।”
এই বক্তব্যগুলো তাঁর বই ও কলামে বারবার উঠে এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে ‘ব্লাসফেমাস’ (ধর্মদ্রোহী) হিসেবে ঘোষণা করে।

৫. কেন তিনি এসব বলেছিলেন? যুক্তি ও দর্শন

তসলিমা নাসরিন নিজেকে একজন “মানবতাবাদী, নারীবাদী ও যুক্তিবাদী” (Humanist, Feminist, Rationalist) হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর বক্তব্য, ধর্মের নামে যে অন্যায় হয়, তাকে “শ্রদ্ধা” নয়—সমালোচনা করাই প্রকৃত নৈতিকতা। তাঁর মূল যুক্তিগুলো:
ধর্ম যদি সমালোচনার ঊর্ধ্বে হয়, তবে তা নিপীড়নকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। → তিনি বলেন, নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, যৌন স্বাধীনতা—সবকিছু ধর্মের মুখোমুখি হলেই বিপন্ন হয়।
যা যুক্তিসঙ্গত নয়, তা মান্য করা উচিত নয়—even যদি সেটা ধর্ম হয়। → ধর্মগ্রন্থে দাসপ্রথা, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন, সহিংসতা থাকলে সেটা অস্বীকার না করে, প্রকাশ্যে সমালোচনা করাই একজন বিবেকবান মানুষের কাজ।
নারীবাদ ও ধর্ম একসাথে চলতে পারে না। → তাঁর মতে, সবধরনের সংগঠিত ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক; আর ইসলাম এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণমূলক।
সাহসই সভ্যতার চালিকাশক্তি। → তসলিমা বলেছিলেন:
“যদি কেউ মেয়েদের স্বাধীনতা চায়, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। আমি কেবল সেই কাজটাই করছি।”
দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:
তাঁর ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে—
নাস্তিক্যবাদ (Atheism) → তিনি বিশ্বাস করেন না কোনো ঈশ্বর, ফেরেশতা বা পবিত্র কিতাবে।
সেক্যুলারিজম (Secular Humanism) → মানবতা, সমতা ও যুক্তিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে উপরে রাখেন।
এক্সিস্টেনশিয়াল স্বাধীনতা (Existential Freedom)

→ মানুষ নিজেই তার মূল্য নির্ধারণ করে; ধর্ম বা ঐশ্বরিক নির্দেশনা নয়।

৬. কীভাবে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়া আসে ও দেশত্যাগ

তসলিমা নাসরিনের বক্তব্যগুলো যখন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা বাংলাদেশসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিশেষ করে তাঁর লেখা "লজ্জা" উপন্যাস, যেখানে মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু নির্যাতনের কথা বলা হয়, সেটাই ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো। মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াগুলো: ফতোয়া ও হত্যার হুমকি একাধিক ইসলামি দল ও মৌলবাদী আলেম তসলিমার বিরুদ্ধে “মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া” জারি করে। বলা হয়, তিনি “ইসলাম ও নবীকে অপমান করেছেন”, তাই তাঁর “গর্দান নেওয়া ফরজ”। রাস্তায় বিক্ষোভ, বই পোড়ানো ও পুলিশের নিরাপত্তা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল, তার বই পোড়ানো, এমনকি তাঁর ছবি আগুনে ফেলা হয়। তাঁকে হত্যার চেষ্টা হতে পারে এমন আশঙ্কায় সরকার তাঁকে আধা-গোপন নিরাপত্তা হেফাজতে রাখে। মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে মামলা হয় এবং ওয়ারেন্ট জারি করা হয়।
দেশত্যাগ: নির্বাসনের শুরু
১৯৯৪ সালে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায়। তখন তসলিমা:
বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান।
পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পান—বিশেষ করে সুইডেন এবং ফ্রান্সে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিছুদিন বসবাস করলেও সেখানেও মুসলিম মৌলবাদীদের প্রতিবাদের মুখে তাঁকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
তসলিমার ভাষ্য:
“আমি সত্য বলেছি, আর সত্য বলার শাস্তি হচ্ছে নির্বাসন, মৃত্যু হুমকি, এবং নিজের দেশ থেকে চিরবিদায়।”

৭. সমর্থন ও বিরোধ—পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিক্রিয়া

তসলিমা নাসরিনের কথা ও কাজ যতোটা বিতর্ক তৈরি করেছে, ততোটা ধারালো বিভাজনও তৈরি করেছে সমাজে। কেউ তাঁকে দেখেন "নারীর মুক্তির অগ্রদূত" হিসেবে, কেউ আবার "ইসলাম-বিদ্বেষী ষড়যন্ত্রী" হিসেবে। সমর্থনের পক্ষ:
নারীবাদী আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মীরা
অনেকেই তাঁর লেখা ও অবস্থানকে নারী স্বাধীনতার পক্ষে সাহসী আওয়াজ হিসেবে দেখেন।
আন্তর্জাতিক নারী সংগঠনগুলো, যেমন Amnesty International বা PEN International, তাঁকে লেখার স্বাধীনতার প্রতীক বানিয়েছে।
নাস্তিক ও সেক্যুলার চিন্তাবিদেরা
অভিজিৎ রায়ের মতো যুক্তিবাদী চিন্তার ধারার মানুষ তাঁকে যুক্তিবাদী বিপ্লবের অংশ মনে করেন।
পশ্চিমা মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা
BBC, New York Times, The Guardian প্রভৃতি তাঁকে “দমবন্ধ পরিবেশে মুক্তচিন্তার প্রতীক” হিসেবে তুলে ধরেছে।
বিরোধের পক্ষ:
ইসলামি দল ও গোষ্ঠী
তাঁরা মনে করেন তসলিমা ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।
হেফাজতে ইসলাম, জামাতে ইসলামীসহ অনেক গোষ্ঠী তাঁকে “মুরতাদ” আখ্যা দিয়ে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে।
সরকারি দ্বৈত অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার কখনো তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, আবার কখনো চাপে পড়ে তাঁকে দেশছাড়া করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একই রকম দ্বৈত আচরণ করেছে—আশ্রয় দিলেও পরবর্তীতে বিতাড়ন করে।
অনেক সাধারণ মুসলমানের প্রতিক্রিয়া
এমনকি যাঁরা মৌলবাদী নন, তাঁরাও তাঁর কিছু বক্তব্যকে অত্যন্ত উগ্র ও আঘাতমূলক বলে মনে করেন।
তসলিমার বক্তব্য:
“আমি ধর্মকে নয়, ধর্ম দিয়ে অন্যায়কে আঘাত করেছি। যারা সত্যের পক্ষ নেয় না, তারাই আসল দোষী।”

h2 id="point8">৮. তাঁর বই ও লেখায় ইসলামবিষয়ক বক্তব্য

তসলিমা শুধুমাত্র বক্তৃতা বা কলামে নয়, তাঁর সাহিত্য ও আত্মজীবনীমূলক বইগুলোতেও স্পষ্টভাবে ইসলাম সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন। এইসব লেখাই তাঁকে অনেকে সাহসী বলেন, আবার অনেকেই চরমভাবে নিন্দা করেন। ১. লজ্জা (১৯৯৩)
এটি একটি উপন্যাস হলেও মূলত ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মুসলিমদের প্রতিশোধমূলক নির্যাতনের কাহিনি তুলে ধরা হয়।
বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেশে ও বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
ইসলামপন্থীরা বলেন, এটি "ইসলামকে অপমান করেছে"।
উদ্ধৃতি: “ধর্ম যখন সহানুভূতির চেয়ে প্রতিশোধে বিশ্বাস করে, তখন মানবতা বিপন্ন হয়।”

২. আমার মেয়েবেলা (আত্মজীবনী, খণ্ড-১)

এখানে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি ইসলামী শিক্ষার নামে বাধ্যতামূলক পর্দা, নামাজ, রোজা, এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের চিত্র দেখিয়েছেন।
তিনি প্রশ্ন তোলেন—“কেন মেয়েরা আলাদা করে রাখা হয়? কেন আল্লাহ পুরুষদের বেশিরভাগ স্বাধীনতা দিয়েছেন?”
৩. উতল হাওয়া, ক (Autobiography series)
এসব খণ্ডে তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, সমাজে ইসলামপন্থীদের চাপ, এবং তাঁর জীবনে ধর্মের নেতিবাচক প্রভাব আলোচনা করেন।
ইসলাম সম্পর্কে কড়া ভাষায় বলেন, অনেক সময় হাদিসের বক্তব্য তুলে দিয়ে তাঁর যুক্তি দেখান।
৪. নারীর কোন দেশ নেই (No Country for Women)
এখানে তিনি বলেন:
“ইসলাম নারীর জন্য নয়, পুরুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ধর্মীয় মুখোশ।”
পর্দা, বিবাহ, তালাক, ইদ্দত, পলিগ্যামি, ফতোয়া ইত্যাদি ইসলামী বিধানের কড়া সমালোচনা করেছেন।
৫. কলাম ও প্রবন্ধসমূহ
বিভিন্ন সময়ে তিনি ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লিখেছেন যেমনঃ
“ইসলাম কোনো মানবতাবাদ নয়”
“নবীর ১১ স্ত্রী থাকা কি নারীবাদের সঙ্গে যায়?”
“আল্লাহ কি আসলেই নারীকে মানুষ ভাবেন?”
তাঁর লেখায় বারবার যে বক্তব্য উঠে এসেছে:
ধর্মের ভিতর যদি মানবতা না থাকে, তবে তা কেবল নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নের হাতিয়ার।
ইসলাম ধর্ম নারীকে দাস বানানোর শিক্ষা দেয়—এটা তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ।

৯. ধর্মের সমালোচনার অধিকার বনাম ধর্মীয় অনুভূতি

এই বিতর্ক শুধু তসলিমাকে ঘিরে না, বরং সমগ্র পৃথিবীর মুক্তচিন্তা বনাম ধর্মীয় সংবেদনশীলতার দ্বন্দ্ব এখানে প্রতিফলিত হয়। ⚖️ ধর্মের সমালোচনা কি মুক্তচিন্তার অধিকার?
প্রশ্ন করার অধিকারই সভ্যতার ভিত্তি
সব ধর্মই এক সময়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে।
খ্রিস্টান ধর্মে গ্যালিলিও বা জর্দানো ব্রুনো, হিন্দু ধর্মে রাজা রামমোহন রায়—তাঁরাও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
ধর্ম যেহেতু সমাজের বড় প্রভাবক, তাই তার সমালোচনা অপরিহার্য
রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন—সবকিছুই সমালোচিত হতে পারে। তাহলে ধর্ম আলাদা কেন হবে?
তসলিমা যুক্তির ভাষায় ধর্মের বিরোধিতা করেছেন, সহিংসতার মাধ্যমে না
তিনি বলেন,
“কোরআন বা হাদিসে যা আছে, আমি সেগুলো তুলে ধরে প্রশ্ন করেছি। যদি সেগুলোই সমস্যা না হয়, তাহলে আমার প্রশ্ন কীভাবে সমস্যা?”
কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রসঙ্গ?
ধর্মবিশ্বাস অনেকের কাছে একান্ত, আবেগের বিষয়
এ কারণে কেউ ধর্মের সমালোচনা করলেই তাঁরা মনে করেন সেটি “ব্যক্তিগত আঘাত”।
বিপদ দেখা যায় যখন সমালোচনাকে কটাক্ষ বা অপমান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়
সমালোচনা আর বিদ্বেষের পার্থক্য অনেকেই বোঝে না বা বোঝাতে চায় না।
আইনগত চাপে বাকস্বাধীনতা ব্যাহত হয়
বাংলাদেশে ৫৭ ধারা, ভারতের ১৫৩A/295A ধারা—এইসব আইনের কারণে বহু লেখক, শিল্পী চুপ থাকতে বাধ্য হন।
উদাহরণ:
তসলিমা নাসরিন কোরআনের নারী সংক্রান্ত আয়াতের সমালোচনা করেছিলেন। অনেকে বলেছিল, “এই আয়াত তো কেবল আরবদের প্রসঙ্গে বলা।” তসলিমার প্রশ্ন ছিল, “তাহলে আজও কেন এইসব আয়াত প্রয়োগ হয় নারীর উপর?”
তাহলে সমাধান কোথায়?
সমালোচনা থাকতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে, বিদ্বেষ নয়।
ধর্মীয় মানুষকেও জানতে হবে—কোনো ধারণা চ্যালেঞ্জ করা মানে ব্যক্তিকে আঘাত করা নয়।
রাষ্ট্রকেও নিশ্চয়তা দিতে হবে—কেউ যদি সহিংস না হয়, তবে তাকে দমন করা যাবে না।

১০. নির্বাসিত জীবন ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

তসলিমা নাসরিনের সাহসী লেখালেখি শুধুই বিতর্ক আনেনি, বরং তাঁকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করে এক নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে। 🌍 দেশছাড়া: ধর্মীয় চাপ বনাম রাষ্ট্রের নতজানুতা
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়
"লজ্জা" বই প্রকাশের পর ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়।
ইসলামী দলগুলো দাবি তোলে তাঁর "মৃত্যুদণ্ড" দেওয়ার।
সরকার তাঁর বিরুদ্ধে "ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত" করার অভিযোগে মামলা করে।
পাসপোর্ট বাতিল ও নাগরিকত্ব ঝুঁকিতে পড়ে
সরকার তাঁর পাসপোর্ট নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে তিনি ‘নাগরিকবিহীন’ হয়ে পড়েন।
বহু বছর বিদেশে থাকার পরও তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি।
ভারতে আশ্রয় এবং বিতাড়ন
ভারত তাঁকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়
কলকাতায় তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান।
২০০৭ সালে একটি সেমিনারে ইসলামের সমালোচনা করলে কলকাতা ও হায়দরাবাদে দাঙ্গা শুরু হয়।
ভারত সরকার তাঁকে গৃহবন্দী করে ও পরে তাড়িয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজনৈতিক চাপের মুখে তাঁকে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়।
তিনি দিল্লি বিমানবন্দরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন—
“আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমি কেবল লেখক। আমাকে কেন এভাবে তাড়ানো হচ্ছে?”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: সমর্থন ও পুরস্কার
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানায়
Amnesty International, PEN International ইত্যাদি সংগঠন তসলিমার বাক-স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে।
বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন
যেমনঃ
Sakharov Prize (EU)
Human Rights Award (France)
Ananda Purashkar

UNESCO prize (পরে বাতিল হয় চাপের কারণে)

তাঁকে “সাহসী নারী”, “নির্যাতিত বুদ্ধিজীবী” হিসেবে তুলে ধরা হয়
পশ্চিমা বিশ্বে তসলিমার বই অনুদিত হয় বহু ভাষায়।
অথচ স্বদেশে তাঁর নামে অবমাননা
বাংলাদেশে তাঁর লেখা নিষিদ্ধ।
তাঁর নামে এখনো “নাস্তিক”, “ইসলাম-বিদ্বেষী”, “পশ্চিমা দালাল” ইত্যাদি অপবাদ চালু আছে।
অনেকে বলেই বসে: “তসলিমা বললেই বুঝি ইসলামকে গালাগাল।”

Post a Comment

Previous Post Next Post