ওহী নাকি কপি? কুরআন ও বাইবেলের আয়াত ধরে বিশ্লেষণ

সূচিপত্র:

  1. ১. ভূমিকা
  2. ২. বাইবেলের কাহিনির সারাংশ
  3. ৩. কুরআনের কাহিনির সারাংশ
  4. ৪. কাহিনির মিল
    1. ৪.১ প্লাবনের কারণ
    2. ৪.২ নৌকা নির্মাণ
    3. ৪.৩ প্লাবনের বিবরণ
    4. ৪.৪ নৌকার অবস্থান
    5. ৪.৫ পাখি পাঠানো
    6. ৪.৬ পরিবার ও বিশ্বাসী
    7. ৪.৭ কাহিনির উদ্দেশ্য
    8. ৪.৮ ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়া
    9. ৪.৯ সময়কাল ও জলস্তর
    10. ৪.১০ ঈশ্বর বনাম আল্লাহ
    11. ৪.১১ নূহের ভুল ও তার পরিণতি
    12. ৪.১২ বার্তার প্রেরণ
  5. ৫. পার্থক্য
    1. ৫.১ ভাষাগত পার্থক্য
    2. ৫.২ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
    3. ৫.৩ কাহিনির প্রেক্ষাপট ও গঠন
  6. ৬. পার্থক্যগুলো ও বিতর্কিত বিষয়
    1. ৬.১ নূহের সন্তানদের নাম ও সংখ্যা
    2. ৬.২ প্লাবনের ব্যাপ্তি – স্থানীয় না বৈশ্বিক
    3. ৬.৩ ঈশ্বর ও আল্লাহর ব্যাখ্যার পার্থক্য
  7. ৭. গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
    1. ৭.১ ঐতিহাসিক গবেষণা
    2. ৭.২ ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
    3. ৭.৩ ধর্মীয় ব্যাখ্যা বনাম একাডেমিক মত
  8. ৮. উপসংহার

১. ভূমিকা: কুরআন কি বাইবেল থেকে কপি করা হয়েছে?

ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মিল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যখন সেই মিল অবিকল হুবহু বা অসাধারণভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়—তখন প্রশ্ন ওঠে: "এই মিল কি কাকতালীয়? না কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুলিপি?"

এই ব্লগে আমরা খতিয়ে দেখব—
- বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে যেসব আয়াত, গল্প বা শিক্ষার অদ্ভুত রকম সাদৃশ্য রয়েছে,
- তা কতটা হুবহু,
- এগুলোর ঐতিহাসিক উৎস কী,
- এবং সত্যিই কি কুরআনের অনেক অংশ বাইবেল থেকে অনুলিপি করা হয়েছে?

এই প্রশ্ন শুধু ধর্মীয় নয়, বরং ঐতিহাসিক ও দর্শনগত। তাই এই ব্লগে আমরা কেবল কুরআন বা বাইবেলের অনুলিপি নয়, বরং ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও প্রাচীন সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ব্যবহার করব।

২. বাইবেল ও কুরআনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

বাইবেল: বাইবেল হলো খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ। এটি দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: পুরাতন নিয়ম (Old Testament) এবং নতুন নিয়ম (New Testament)

- পুরাতন নিয়মে ইহুদি জাতির ইতিহাস, ধর্মীয় আইন, নবীদের বাণী এবং গীতসংহিতা (Psalms) রয়েছে।
- নতুন নিয়মে যিশুর জীবন, উপদেশ ও খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের ভিত্তি বর্ণনা করা হয়েছে।

বাইবেল বহু লেখকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, প্রায় ১৫০০ বছর ধরে। এর প্রাচীনতম অংশ হিব্রু ভাষায়, এবং নতুন অংশ গ্রিক ভাষায় লেখা।

কুরআন: কুরআন ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ। মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী এটি মুহাম্মদকে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে, জিবরাঈল ফেরেশতার মাধ্যমে।

- কুরআন আরবি ভাষায় লেখা
- মোট ১১৪টি সূরা (অধ্যায়) এবং ৬২৩৬টি আয়াত (পঙক্তি) নিয়ে গঠিত
- মুসলিমদের মতে কুরআন "অতুলনীয়", এবং "চিরন্তনভাবে অপরিবর্তিত"

তবে ইতিহাসবিদদের মতে কুরআনের অনেক উপাদান বাইবেল, অ্যাপোক্রাইফা (Bible-এর বাইরের ধর্মগ্রন্থ), এবং আরবের আগে থেকে প্রচলিত মৌখিক কাহিনি থেকে এসেছে।

৩. মিলগুলোর ধরন ও শ্রেণিবিন্যাস

বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে যে মিলগুলো রয়েছে, সেগুলোকে প্রধানত নিচের শ্রেণিতে ভাগ করা যায়ঃ

  1. কাহিনিভিত্তিক মিল: অনেক নবীর কাহিনি (যেমন: আদম, নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, ঈসা) দুই ধর্মগ্রন্থেই প্রায় একইরকম বর্ণিত হয়েছে।
  2. নৈতিক শিক্ষা ও আদেশ: ঈশ্বরভীতি, দয়া, সততা, জাকাত বা দান, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার — এসব নৈতিক বাণী দুইটিতেই কমবেশি অভিন্ন।
  3. আইন ও নিষেধাজ্ঞা: খাদ্যবিধি (যেমন শুকরের মাংস নিষিদ্ধ), চুরি বা ব্যভিচারের শাস্তি — এসব নিয়ম বাইবেল ও কুরআন উভয়েই রয়েছে।
  4. শেষ বিচার ও আখিরাত: পুনর্জন্ম নয় বরং স্বর্গ-নরকের ধারণা, ও ‘শেষ বিচারের দিন’ — উভয় গ্রন্থেই বর্ণিত।
  5. কথ্যভাষার ও বক্তব্যের মিল: অনেক সময় হুবহু বাক্য বা বাক্যাংশ মিলে যায়, যা নিচের বিশ্লেষণে তুলে ধরা হবে।

এই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী আমরা পরবর্তী পয়েন্টগুলোতে হুবহু মিল বা অনুরূপ অংশের উদাহরণ তুলে ধরবো।

৪. হুবহু মিল: বাইবেল বনাম কুরআন

এখানে বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে যতগুলো হুবহু বা অত্যন্ত অনুরূপ আয়াত, বাক্যাংশ বা কাহিনি রয়েছে, সেগুলো পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো। প্রতিটি মিলের ক্ষেত্রে বাইবেল ও কুরআনের অংশ পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে যেন মিলটি একনজরে বোঝা যায়।

৪.১ আদম ও নিষিদ্ধ ফল: আদম, ঈভ (হাওয়া), ও সাপ

বাইবেল (উৎপত্তি ৩:৪-৫):
"তখন সাপ স্ত্রীলোককে বলল, 'তোমরা নিশ্চিতভাবে মরবে না। কারণ ঈশ্বর জানেন, যেদিন তোমরা তা খাবে, তোমাদের চোখ খুলে যাবে, আর তোমরা ঈশ্বরের মত হব—ভাল ও মন্দ জানবে।'"

কুরআন (সূরা আরাফ ৭:২০):
"অতঃপর শয়তান তাদের উভয়কে কুমন্ত্রণা দিল, যাতে সে তাদের সামনে প্রকাশ করে তাদের গোপন অঙ্গ, যা তাদের দৃষ্টির অগোচর ছিল। সে বলল, 'তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের এ বৃক্ষ নিষিদ্ধ করেননি, কিন্তু এজন্য যে, তোমরা যেন দেবদূত না হয়ে যাও বা চিরজীবী না হয়ে যাও।'"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থেই নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পেছনে এক প্রতারকের ভূমিকা (সাপ/শয়তান) রয়েছে, যারা মানুষকে ঈশ্বরের মত হয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়। মূল বক্তব্য ও ফলাফল প্রায় অভিন্ন।

৪.২ কাইনের হত্যাকাণ্ড: হাবিল ও কাবিল

বাইবেল (উৎপত্তি ৪:৮):
"তখন কাইন তার ভাই আবেলকে বলল, ‘চলো মাঠে যাই।’ তারা যখন মাঠে ছিল, তখন কাইন তার ভাই আবেলের উপর আক্রমণ করল এবং তাকে হত্যা করল।"

কুরআন (সূরা মায়েদা ৫:২৭-৩০):
"তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনী যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল। তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হয়েছিল এবং অপরেরটা কবুল হয়নি। সে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।’... অতঃপর তার মন তাকে প্ররোচিত করল তার ভাইকে হত্যা করতে এবং সে তাকে হত্যা করল।"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থে আদমের দুই ছেলের একজন অপরজনকে হত্যা করে। ঈর্ষা ও কুরবানী অগ্রহণযোগ্যতা—দুই জায়গাতেই মূল মোটিভ। পার্থক্য শুধু নামে: বাইবেলে 'কাইন ও আবেল', কুরআনে 'নামহীন' তবে হাদিসে 'হাবিল ও কাবিল'।

৪.৩ নূহের নৌকা: প্রলয় ও উদ্ধার

বাইবেল (আদিপুস্তক ৬:১৩-১৪):
"তখন ঈশ্বর নূহকে বললেন, ‘আমি সমস্ত জীবকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি... তুমি গোফার কাঠ দিয়ে তোমার জন্য একটি নৌকা তৈরি করো।’"

কুরআন (সূরা হূদ ১১:৩৭):
"তুমি আমার চোখের সামনে এবং আমার ওহী অনুযায়ী একটি নৌকা নির্মাণ কর।"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বর/আল্লাহ নূহকে এক বিশাল বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে নির্দেশ দেন একটি নৌকা বানাতে। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তাতে উঠে প্রাণে বেঁচে যান। কাঠামো ও কাহিনির রূপরেখা একই, শুধু ভাষাগত পার্থক্য।

৪.৪ মূসা ও ফিরাউন: ঈশ্বরের বার্তা ও সাগর বিভাজন

বাইবেল (প্রস্থান ১৪:২১-২৮):
"তখন মূসা তাঁর হাত সমুদ্রের উপর প্রসারিত করলেন, এবং প্রভু এক সারা রাত ধরে প্রবল পূর্বী হাওয়া বইয়ে সমুদ্র সরিয়ে দিলেন... পানি বিভক্ত হয়ে গেল।... ইস্রায়েলীয়রা শুকনো ভূমির উপর দিয়ে পার হলো... তারপর পানির ঢেউ ফিরে এসে মিসরীয়দের ঢেকে ফেলল।"

কুরআন (সূরা শুআরা ২৬:৬৩-৬৬):
"তখন আমি মূসার প্রতি ওহী করলাম: ‘তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রকে আঘাত কর।’ তখন তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং প্রতিটি খণ্ড ছিল একটি বিরাট পর্বতের মতো।... আমি অন্যদেরকে (ফিরাউনের দল) সেখানে ডুবিয়ে দিলাম।"

বিশ্লেষণ: সমুদ্র বিভাজন, ইস্রায়েলীয়দের রক্ষা, আর মিসরীয়/ফিরাউনের ডুবে যাওয়া — দুই ধর্মগ্রন্থেই একরকম। মূসার ভূমিকা, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ও পানির বিভাজন — কাহিনির মূল কাঠামো অভিন্ন।

৪.৪ মূসা ও ফিরাউন: ঈশ্বরের বার্তা ও সাগর বিভাজন

বাইবেল (প্রস্থান ১৪:২১-২৮):
"তখন মূসা তাঁর হাত সমুদ্রের উপর প্রসারিত করলেন, এবং প্রভু এক সারা রাত ধরে প্রবল পূর্বী হাওয়া বইয়ে সমুদ্র সরিয়ে দিলেন... পানি বিভক্ত হয়ে গেল।... ইস্রায়েলীয়রা শুকনো ভূমির উপর দিয়ে পার হলো... তারপর পানির ঢেউ ফিরে এসে মিসরীয়দের ঢেকে ফেলল।"

কুরআন (সূরা শুআরা ২৬:৬৩-৬৬):
"তখন আমি মূসার প্রতি ওহী করলাম: ‘তোমার লাঠি দিয়ে সমুদ্রকে আঘাত কর।’ তখন তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং প্রতিটি খণ্ড ছিল একটি বিরাট পর্বতের মতো।... আমি অন্যদেরকে (ফিরাউনের দল) সেখানে ডুবিয়ে দিলাম।"

বিশ্লেষণ: সমুদ্র বিভাজন, ইস্রায়েলীয়দের রক্ষা, আর মিসরীয়/ফিরাউনের ডুবে যাওয়া — দুই ধর্মগ্রন্থেই একরকম। মূসার ভূমিকা, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ও পানির বিভাজন — কাহিনির মূল কাঠামো অভিন্ন।

৪.৫ ঈসা/যীশুর অলৌকিক জন্ম: কুমারী মেরি/মারিয়াম

বাইবেল (লূক ১:৩৪-৩৫):
"মেরি বললেন, 'এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো কোনো পুরুষকে জানি না।' ফেরেশতা উত্তর দিলেন, ‘পবিত্র আত্মা তোমার উপর আসবে... এজন্য তোমার গর্ভের সন্তান ঈশ্বরের পুত্র বলে পরিচিত হবে।’"

কুরআন (সূরা আল ইমরান ৩:৪৭):
"সে বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! কিভাবে আমার সন্তান হবে, যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি?’ তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা চান সৃষ্টি করেন...’"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থেই যীশু/ঈসার জন্ম হয় কুমারী মায়ের গর্ভে, পুরুষের সাহায্য ছাড়াই। বাইবেল একে ঈশ্বরের পুত্রত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে, আর কুরআন একে অলৌকিক সৃষ্টির দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে। ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও ঘটনাটি মূলত অভিন্ন।

৪.৬ দশ আদেশ বনাম কুরআনের অনুরূপ বিধান

বাইবেল (নির্গমন ২০:৩-১৭):
১. তুমি আমার ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বরের উপাসনা করো না।
২. কোনো মূর্তি গড়ে পূজা করো না।
৩. ঈশ্বরের নাম অপব্যবহার করো না।
৪. বিশ্রামের দিন পবিত্র রাখো।
৫. পিতা-মাতার সম্মান করো।
৬. হত্যা করো না।
৭. ব্যভিচার করো না।
৮. চুরি করো না।
৯. মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না।
১০. অপরের জিনিসের প্রতি লোভ করো না।

কুরআন (বিভিন্ন সূরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে):
১. তাওহিদ: “আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করো না।” (সূরা নিসা ৪:৩৬)
২. মূর্তি পূজার নিষেধ: “তোমরা মূর্তিগুলোর পূজা করো না।” (সূরা আনআম ৬:১৫১)
৩. আল্লাহর নামের অপব্যবহার নিষিদ্ধ: (সূরা বাকারা ২:২২৪)
৪. জুমার দিন পবিত্র রাখার নির্দেশনা: (সূরা জুমু’আ ৬২:৯)
৫. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার: (সূরা বনি ইসরাইল ১৭:২৩)
৬. হত্যা নিষিদ্ধ: “কোন প্রাণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না।” (সূরা মায়েদা ৫:৩২)
৭. ব্যভিচার নিষিদ্ধ: “ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না।” (সূরা ইসরা ১৭:৩২)
৮. চুরি নিষিদ্ধ: (সূরা মায়েদা ৫:৩৮)
৯. মিথ্যা সাক্ষ্য নিষিদ্ধ: (সূরা হজ্জ ২২:৩০)
১০. লোভের প্রতি নিষেধ: (সূরা ত্বহা ২০:১৩১)

বিশ্লেষণ: বাইবেলের "Ten Commandments" এবং কুরআনের নির্দেশনাগুলো বিষয়বস্তুর দিক থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যদিও কুরআনে এগুলো আলাদাভাবে বর্ণিত, কিন্তু আদেশগুলোর নীতিগত বক্তব্য প্রায় অভিন্ন।

৪.৭ আয়ুব/জব: ধৈর্যের পরীক্ষা ও পুনরুদ্ধার

বাইবেল (ইয়োব/জব ২:৩-৭):
"তখন প্রভু শয়তানকে বললেন, ‘তুমি কি আমার দাস জবের প্রতি লক্ষ্য করেছ?... সে এখনো নির্দোষ ও ধার্মিক।’... শয়তান তাকে শারীরিক কষ্ট দিল, পায়ের তলা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘা দিয়ে ভরিয়ে দিল।"

কুরআন (সূরা সাদ ৩৮:৪১-৪৪):
"আর তুমি আমার বান্দা আয়ুবকে স্মরণ করো, যখন সে বলেছিল, ‘নিশ্চয় শয়তান আমাকে কষ্ট ও দুঃখ দিয়েছে।’... আমি বললাম, ‘তুমি তোমার পা দিয়ে মাটি মারো; এটা হলো স্নান ও পানির ঝর্ণা।’... আমি তাকে তার পরিবার ফিরিয়ে দিলাম এবং আরও দ্বিগুণ দিলাম।"

বিশ্লেষণ: আয়ুব (Job) কাহিনিতে দুই ধর্মগ্রন্থেই একে ধার্মিক ব্যক্তির ধৈর্যের পরীক্ষা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। শয়তানের মাধ্যমে কষ্ট, ঈশ্বরের প্রতি তার অনমনীয় বিশ্বাস, এবং শেষমেশ পুরস্কার — কাহিনির মূল কাঠামো অভিন্ন, কেবল উপস্থাপনার ভঙ্গি আলাদা।

৪.৮ জিবরাঈল ও গ্যাব্রিয়েল: ঐশী বার্তাবাহক

বাইবেল (লূক ১:২৬-২৮):
"ঈশ্বর গ্যাব্রিয়েল নামক ফেরেশতাকে গালিলির নাসরত নামক এক নগরে পাঠালেন... সে কুমারী মেরির কাছে গিয়ে বলল, ‘হে অনুগ্রহপ্রাপ্ত, প্রভু তোমার সঙ্গে আছেন।’"

কুরআন (সূরা মারইয়াম ১৯:১৭-১৯):
"...তখন আমি তার কাছে আমার রুহ পাঠালাম এবং সে পূর্ণ মানুষরূপে তার সামনে উপস্থিত হলো।... সে বলল, ‘আমি তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত দূত, যেন আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র দান করি।’"

বিশ্লেষণ: গ্যাব্রিয়েল ও জিবরাঈল— দুই নাম হলেও একই চরিত্র। কুমারী মায়ের কাছে ঈশ্বরের বার্তা আনা এবং অলৌকিক জন্ম ঘোষণা — ঘটনাগুলোর কাঠামো অভিন্ন। কুরআনে তাকে ‘রুহ’ বা ‘রুহুল কুদুস’ বলা হয়েছে, বাইবেলে ‘অ্যাঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল’। নামের পার্থক্য ছাড়া কার্যত কোনো পার্থক্য নেই।

৪.৯ আদম ও নিষিদ্ধ ফল: পাপের সূচনা

বাইবেল (উৎপত্তি ২:১৬-১৭, ৩:১-৬):
ঈশ্বর আদমকে বলেছিলেন, "তুমি বাগানের সব গাছের ফল খেতে পারো, কিন্তু জ্ঞানের গাছের ফল খাবে না...।" পরে সাপ এসে ইভকে প্রলুব্ধ করে, সে ফল খায় এবং আদমকেও দেয়। তখন তারা উভয়েই নগ্নতা উপলব্ধি করে এবং ঈশ্বর তাদের বাগান থেকে বের করে দেন।

কুরআন (সূরা বাকারা ২:৩৫-৩৬):
"আর আমি আদমকে বললাম, ‘তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো... কিন্তু এই গাছটির কাছেও যেয়ো না, নয়তো তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ কিন্তু শয়তান তাদের ফুঁসলালো, ফলে তারা উভয়ে গাছ থেকে খেল এবং লজ্জাস্থান প্রকাশ পেল।"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থেই আদম ও তাঁর সঙ্গিনীর নিষিদ্ধ ফল খাওয়া এবং তারপর তাদের পতন ঘটার কাহিনি রয়েছে। বাইবেলে সাপ (শয়তান) ইভকে প্রলুব্ধ করে, কুরআনে সরাসরি শয়তান আদম ও তার স্ত্রীকে প্ররোচিত করে। উপাদান এক, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।

৪.১০ কাবিল ও হাবিল বনাম কেইন ও অ্যাবেল: মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যা

বাইবেল (উৎপত্তি ৪:২-৮):
“কেইন কৃষিজ ও অ্যাবেল পশুপালক ছিল। ঈশ্বর অ্যাবেলের উৎসর্গ গ্রহণ করেন, কিন্তু কেইনেরটা না করায় কেইন রাগে তার ভাইকে মাঠে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।”

কুরআন (সূরা মায়েদা ৫:২৭-৩১):
“তুমি তাদের সামনে আদমের দুই পুত্রের কাহিনি পাঠ করো... একজন উৎসর্গ গ্রহণ করলো, আরেকজন করলো না। যে করলো না সে বলল, ‘আমি তোকে হত্যা করব।’... সে তাকে হত্যা করল ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। পরে আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, সে কিভাবে মৃতদেহ ঢেকে রাখতে হয় তা শেখালো।”

বিশ্লেষণ: এই দুই গল্পে শুধু নামের পার্থক্য — কেইন/কাবিল ও অ্যাবেল/হাবিল। ঈর্ষা, উৎসর্গ, হত্যার উদ্দেশ্য ও পরিণাম — সবকিছুই অভিন্ন। কুরআন অতিরিক্তভাবে ‘কাক পাঠানো’ ও ‘লাশ ঢাকার শিক্ষা’ যোগ করেছে, যা বাইবেলে অনুপস্থিত।

৪.১১ নূহ ও মহাপ্লাবন: ঈশ্বরের শাস্তি ও নৌকার কাহিনি

বাইবেল (উৎপত্তি ৬:১৩-২২, ৭:১৭-২৪):
ঈশ্বর নূহকে বলেন, "আমি মানুষজাতিকে ধ্বংস করব... তুমি একটি জাহাজ তৈরি করো।" নূহ ঈশ্বরের নির্দেশ মতো এক একটি জোড়া করে সব জীবের রেখার সঙ্গে নৌকায় ওঠেন। মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হয়, কেবল নূহ ও তার সঙ্গীরা বেঁচে থাকেন।

কুরআন (সূরা হুদ ১১:৩৬-৪৮, সূরা নূহ ৭১:১-২৮):
"আমি নূহকে ওহি করলাম, ‘তোমার কওমের কেউ বিশ্বাস করবে না... তাই তুমি আমার নির্দেশে একটি নৌকা তৈরি করো।’ নূহ প্রতি কওমকে সতর্ক করেন, কিন্তু তারা উপহাস করে। এরপর প্লাবন আসে, নৌকা ভেসে চলে, আর অবিশ্বাসীরা ডুবে যায়।"

বিশ্লেষণ: দুই কাহিনির কাঠামো অভিন্ন — ঈশ্বরের আদেশে নৌকা বানানো, বেছে নেওয়া প্রাণীদের সংরক্ষণ, বিশ্বজনীন প্লাবন এবং অবিশ্বাসীদের ধ্বংস। তবে কুরআনে নূহের পুত্র ডুবে যাওয়ার ঘটনা এবং নূহের দোয়া রয়েছে, যা বাইবেলে নেই।

৪.১২ ইব্রাহিম ও পুত্র বিসর্জন: ঈশ্বরের কঠিন পরীক্ষা

বাইবেল (উৎপত্তি ২২:১-১৩):
ঈশ্বর ইব্রাহিমকে বলেন, “তোমার একমাত্র পুত্র ইসহাককে বলিদান দাও।” ইব্রাহিম ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ে যায় এবং বলিদানের জন্য প্রস্তুত হয়, তখন ঈশ্বর ফেরেশতার মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেন এবং একটি ভেড়া সরবরাহ করেন।

কুরআন (সূরা সফফাত ৩৭:১০২-১০৭):
"সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইব্রাহিম বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখছি যে, আমি তোমাকে কুরবান করছি...।’ পুত্র বলল, ‘আপনি যা আদেশ পাচ্ছেন তা করুন।’ যখন দুজনই আনুগত্য দেখাল, তখন আল্লাহ বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করলে।’ এবং তার পরিবর্তে একটি মহান কুরবানি দিলাম।"

বিশ্লেষণ: উভয় ধর্মগ্রন্থেই পিতার আনুগত্য, পুত্র বিসর্জনের প্রস্তুতি ও ঈশ্বরের শেষ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ — এই কাঠামো অভিন্ন। পার্থক্য হচ্ছে — বাইবেল পুত্রের নাম ‘ইসহাক’ বললেও, কুরআনে নাম উল্লেখ নেই; অনেক মুসলিম ইসমাঈল মনে করেন। এছাড়া ‘স্বপ্নে নির্দেশ’ অংশ কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত, বাইবেলে নয়।

৪.১৩ লুত ও সোদোম-গোমোরাহ: যৌন বিকৃতি ও ঈশ্বরের ধ্বংসযজ্ঞ

বাইবেল (আদিপুস্তক ১৯:১-২৯):
ঈশ্বর সোদোম ও গোমোরাহ শহরকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। লুতের বাড়িতে দুই ফেরেশতা আসে। শহরের লোকেরা তাদের ধর্ষণ করতে চায়। লুত তাদের প্রতিহত করে। অবশেষে ঈশ্বর আগুন ও গন্ধকে ঢেলে শহর দুটো ধ্বংস করেন। লুত ও তার পরিবার পালায়, কিন্তু তার স্ত্রী পেছনে তাকানোয় তিনি লবণের স্তম্ভে পরিণত হন।

কুরআন (সূরা হুদ ১১:৭৭-৮৩, সূরা আরাফ ৭:৮০-৮৪, সূরা শোয়ারা ২৬:১৬০-১৭৫):
“আমি লুতকে প্রেরণ করলাম। সে বলল, ‘তোমরা কি জগতে সেই অশ্লীল কাজ করো, যা কেউ করেনি? তোমরা নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কামনা করো?’ তারা বলল, ‘তুমি যদি থামো না, তবে আমরা তোমাকে বহিষ্কার করব।’ এরপর ফেরেশতারা এলেন, এবং শহর উল্টে আগুন ও পাথর বর্ষণ করে ধ্বংস করা হলো।”

বিশ্লেষণ: উভয় গ্রন্থেই গল্পের মূল উপাদান অভিন্ন — পুরুষদের সঙ্গে যৌনতা, ফেরেশতার আগমন, লুতের সতর্কবার্তা, শহরবাসীর প্রতিক্রিয়া, ও ঈশ্বরের ধ্বংস। কুরআনে স্ত্রী পেছনে তাকানোর বিষয়টি সরাসরি বলা না হলেও, তাকে ধ্বংসকৃতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

৫.১ ইউসুফ (জোসেফ) ও স্বপ্ন ব্যাখ্যার কাহিনি

বাইবেল (আদিপুস্তক ৩৭–৪১):
যুবক জোসেফ তার ভাইদের বলেছিল যে সে স্বপ্নে তাদের তাকে নতজানু হতে দেখেছে। ভাইরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে কূপে ফেলে দেয়। সে পরে মিশরে গিয়ে রাজদরবারে স্বপ্ন বিশ্লেষণের জন্য খ্যাতি পায় এবং ফারাও তাকে উপদেষ্টা বানায়।

কুরআন (সূরা ইউসুফ ১২:৪-১০০):
নবী ইউসুফ ছোটবেলায় স্বপ্নে দেখে সূর্য, চাঁদ এবং ১১টি তারা তাকে সিজদা করছে। ভাইয়েরা ঈর্ষায় তাকে কূপে ফেলে দেয়। একজন কাফেলা তাকে উদ্ধার করে বিক্রি করে। সে কারাগারে স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে খ্যাতি অর্জন করে এবং অবশেষে রাজপরিবারের উপদেষ্টা হয়।

বিশ্লেষণ: পুরো গল্পের স্ট্রাকচার এতটাই মিলে যায় যে অনেক ইসলামি স্কলারও স্বীকার করেছেন এটি বাইবেল থেকে অনুপ্রাণিত। কেবল চরিত্রদের সংলাপে আর স্বপ্নের প্রতীকগুলোতে সামান্য ভাষাগত রূপান্তর ঘটেছে। বাইবেল ও কুরআন — উভয়ই ইউসুফকে ‘সততার প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরেছে।

৫.২ মূসা ও ফেরাউন: বাল্যকাল, অলৌকিক লাঠি, ও লাল সাগর বিভাজন

বাইবেল (পপ্রস্থান/ Exodus 1–14):
ফারাও ইহুদি ছেলে শিশুদের হত্যা করার নির্দেশ দেয়। মা মূসাকে ঝুড়িতে নদীতে ভাসিয়ে দেয়; রাজকুমারী তাকে খুঁজে পান ও লালন-পালন করেন। পরে ঈশ্বর মূসাকে পবিত্র ঝোপের মধ্যে ডেকে পাঠান ও আদেশ দেন ফেরাউনের সামনে যেতে। মূসার লাঠি সাপে রূপ নেয়, নানান প্লেগ আসে। শেষে মূসা লাল সাগরের জল দুইভাগ করে ইস্রায়েলিদের পার করে দেন এবং ফেরাউনের সেনারা ডুবে মারা যায়।

কুরআন (সূরা কাসাস ২৮:৩-৪৪, সূরা ত্বোয়াহা ২০:৯-৯৮, সূরা শোয়ারা ২৬:১০-৬৮):
ফেরাউন বনি ইসরাইলের শিশুদের হত্যা করে। মূসার মা তাকে ঝুড়িতে ভাসিয়ে দেয় এবং ফেরাউনের পরিবার তাকে গ্রহণ করে। মূসা ফেরাউনকে আল্লাহর বাণী শোনাতে যান। তার লাঠি সাপে পরিণত হয়। জাদুকরদের সাথে প্রতিযোগিতা হয়। পরবর্তীতে লাল সাগর চিরে বনি ইসরাইল পার হয়ে যায় এবং ফেরাউনের বাহিনী ডুবে যায়।

বিশ্লেষণ: গল্পের মৌলিক কাঠামো, ঘটনার ধারাবাহিকতা, এবং প্রধান অলৌকিক ঘটনাগুলি (যেমন ঝুড়িতে ভাসানো, সাপ বানানো, সাগর চেরা) সবই হুবহু একই। কিছু পার্থক্য রয়েছে ভাষা ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে — বাইবেলে মূসা ঈশ্বরের পুত্রসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখে, কুরআনে সে নবী হিসেবে হাজির হন।

৫.৩ আদম ও হাওয়া: নিষিদ্ধ ফল, সর্প, ও স্বর্গচ্যুতি

বাইবেল (আদিপুস্তক / Genesis 2–3):
ঈশ্বর আদমকে স্বর্গে রাখেন এবং তাকে নিষেধ করেন একটি নির্দিষ্ট গাছের ফল খেতে। হাওয়া আদমের সঙ্গী হন। সর্প হাওয়াকে প্রলুব্ধ করে। হাওয়া আদমকে ফল খাওয়ায়। তারা দুজনেই লজ্জিত হয়ে পড়ে এবং ঈশ্বর তাদের স্বর্গ থেকে বের করে দেন।

কুরআন (সূরা বাকারা ২:৩৫–৩৬, সূরা আরাফ ৭:১৯–২৫, সূরা ত্বোয়াহা ২০:১২০–১২৩):
আল্লাহ আদম ও তার স্ত্রীকে জান্নাতে রাখেন এবং একটি গাছের ফল না খেতে বলেন। শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দেয় এবং তারা ফল খেয়ে ফেলেন। এরপর তারা তাদের লজ্জাস্থান আবিষ্কার করেন এবং আল্লাহ তাদের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন।

বিশ্লেষণ: আদম-হাওয়ার গল্প বাইবেল ও কুরআনে কার্যত এক। দুই জায়গাতেই নিষিদ্ধ ফল, প্রলোভন, পতন এবং স্বর্গচ্যুতি — একই ধাঁচে বর্ণিত। কেবল পার্থক্য হচ্ছে, কুরআনে সর্পের কথা নেই এবং দোষ ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে; যেখানে বাইবেলে হাওয়া প্রলুব্ধকারিণী হিসেবে চিত্রিত।


৬. পার্থক্যগুলো ও বিতর্কিত বিষয়

যদিও বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে অসংখ্য কাহিনীগত মিল রয়েছে, তবুও কিছু দিক থেকে কুরআনের বর্ণনায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ও বিতর্কিত উপাদান। এই পার্থক্যগুলো কুরআনের স্বতন্ত্রতা প্রমাণের চেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও অনেক গবেষকের দৃষ্টিতে তা কপি করতে গিয়ে ভুল বা বিকৃতি বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।

---

৬.১ ফেরাউনের দেহ সংরক্ষণ

কুরআনের দাবি (সূরা ইউনুস ১০:৯২) অনুযায়ী, ফেরাউনের দেহ সংরক্ষিত থাকবে—"আজ আমরা তোমার দেহকে রক্ষা করব যেন তুমি তোমার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিদর্শন হও।" বাইবেলে এরকম কোনো দাবি নেই। অথচ কুরআনের সময়ে বা তার পূর্বে মমি আবিষ্কারের কোনো নিদর্শন নেই। তাই অনেক গবেষকের মতে, এই অংশটি ‘প্রকল্পিত অলৌকিকতা’।

---

৬.২ মেরি (মারিয়াম) ও হারুন

কুরআনে (সূরা মারইয়াম ১৯:২৮) বলা হয়েছে, "হে হারুনের বোন!" অথচ মেরি বা মারইয়াম ছিলেন যীশুর মা, এবং হারুন ছিলেন মূসার ভাই। দুই জনের মধ্যে হাজার বছরের ব্যবধান! এটা একটা সুপরিচিত টাইমলাইনের ভুল যা বহু ইসলামিক স্কলারও স্বীকার করেন, যদিও কেউ বলেন, এখানে 'হারুন' অন্য কেউ হতে পারে — কিন্তু এ দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল।

---

৬.৩ মারইয়ামের জন্ম ও যাজক হিসেবে জাকারিয়া

বাইবেলে বলা হয়েছে, যোহান্নার (John the Baptist) পিতা জাকারিয়া ছিলেন একজন যাজক, কিন্তু কুরআনে তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন তিনি মারইয়ামের তত্ত্বাবধায়ক (সূরা আলে ইমরান ৩:৩৭)। বাইবেলে এমন কিছু নেই। বরং দুই কাহিনির সময়কাল ও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।

---

৬.৪ ঈসার কথা বলা জন্ম

বাইবেলে যীশু জন্মের পর বড় হয়ে বক্তৃতা শুরু করেন, কিন্তু কুরআনে ঈসা নবজাতক থাকা অবস্থায় কথা বলেন (সূরা মারইয়াম ১৯:২৯-৩০)। এটা অলৌকিকতা দেখানোর উদ্দেশ্যে হলেও বাইবেল ও ইতিহাসের দিক থেকে এটা একেবারেই অস্বাভাবিক এবং বিতর্কিত।

---

৬.৫ গজবের সংখ্যা ও ধরণ

বাইবেলে মিশরে ১০টি গজব (Exodus) পাঠানো হয়, কুরআনে ৫টি বা ৯টি গজবের উল্লেখ আছে। যেমন—উপদ্রব, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত। গজবের এই সংখ্যাগত ও ক্রমিক ব্যবধান বহু গবেষকের নজরে এসেছে। এতে মনে হয় কাহিনিটি কপি করতে গিয়ে কিছু বাদ পড়েছে বা পুনর্গঠিত হয়েছে।

৭. গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত

ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও তুলনামূলক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষণাকারী বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই কুরআনে বাইবেল থেকে নেওয়া কাহিনিগুলোর উৎস ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে আসছেন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও গবেষকের অভিমত তুলে ধরা হলো—

---

৭.১ জার্মান ঐতিহাসিক টিওডর নোলডেকে (Theodor Nöldeke)

নোলডেকে কুরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক বিশ্লেষণে বলেন, কুরআনের বহু অংশ বাইবেলের হিব্রু ও আরামাইক কাহিনির প্রতিরূপ। তিনি “Geschichte des Qorans” নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে জিউডিও-ক্রিশ্চিয়ান ফোকলোর ইসলামিক গল্পে রূপান্তরিত হয়েছে।

---

৭.২ রিচার্ড বেল ও মোন্টগোমারি ওয়াট

এরা কুরআনের উৎস ও গঠনের ওপর গবেষণা করে বলেন, মুহাম্মদের প্রাপ্ত বার্তাগুলোতে বাইবেল ও লোককাহিনির প্রভাব স্পষ্ট। বেল মনে করেন, কুরআনের অনেক গল্প তৎকালীন সিরিয়ান খ্রিস্টান গোষ্ঠীর প্রভাব বহন করে। ওয়াট বলেন, মুহাম্মদ বাইবেলের কিছু ধারণা পুনরুৎপাদন করেন যা তিনি মৌখিকভাবে জেনেছেন।

---

৭.৩ ক্রিস্টোফ লুক্সেনবার্গ

লুক্সেনবার্গ বলেন, কুরআনের ভাষা আরবির পূর্বসূরি সিরিয়াক-আরামাইক; এবং অনেক শব্দ বা বাক্য কুরআনে ভুল অনুবাদ হয়েছে, যেগুলোর অর্থ বোঝা যায় সিরিয়াক পটভূমিতে। তিনি দাবি করেন, কুরআনের অনেক অংশ খ্রিস্টীয় ধর্মীয় পাঠ্য থেকে উদ্ভূত।

---

৭.৪ টরোন্টো ইউনিভার্সিটির গবেষণা (2000s)

একটি গবেষণায় কুরআনের কাহিনি ও বাইবেলের বর্ণনার তুলনা করে দেখা হয়, কুরআনের চরিত্র ও কাহিনির কাঠামো অনেকটাই মিল আছে বাইবেলের সঙ্গে, বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্ট ও কিছু অ্যাপোক্রাইফাল গ্রন্থের। গবেষণাটি দেখায়, কুরআন ‘এডাপ্টেড ন্যারেটিভ’ ধারণা অনুসরণ করে।

---

৭.৫ মিশরীয় গবেষক ও প্রাক্তন মুসলিম ড. ইউসুফ সাদেক

ড. সাদেক বলেন, “মুহাম্মদের সময়ে আরব জাহানে খ্রিস্টান ও ইহুদি লোকগল্প প্রচলিত ছিল। তিনি এই গল্পগুলো শুনে সেগুলো নিজের মত করে ব্যবহার করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে পুরোপুরি সম্ভব এবং এতে নবুয়তের দাবি নস্যাৎ হয় না, বরং এটি ব্যাখ্যার একটি পন্থা মাত্র।”

---

৭.৬ অ্যান্ড্রু আর. ম্যাককিনন (বিশ্লেষক ও অধ্যাপক)

ম্যাককিনন বলেন, কুরআন মূলত ধর্মীয় টেক্সট হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গঠিত। বাইবেলের কাহিনিগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক কাঠামো তৈরির জন্য। তাই কাহিনির উৎস নয়, বরং ব্যবহারই ছিল মূল লক্ষ্য।

৮. উপসংহার

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে কুরআন একটি ঐশী গ্রন্থ এবং এর প্রতিটি শব্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। কিন্তু গবেষণা, ইতিহাস ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়— কুরআনে যে কাহিনিগুলো রয়েছে, বিশেষ করে বাইবেল থেকে অনুপ্রবেশ করা গল্পগুলো, সেগুলো বহু পূর্বে থেকেই ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসে প্রচলিত ছিল।

এই কাহিনিগুলোর বেশ কিছু অংশ বাইবেলের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়, আবার কিছু অংশে সামান্য পরিবর্তন করে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাখ্যায় একে বলা হয় “মূলত একই উৎসের কাহিনি”— কিন্তু ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকরা বলেন, এটি একটি ব্যাখ্যাগত কৌশল মাত্র।

উদাহরণস্বরূপ, নূহের প্লাবন, মূসার গল্প, ইব্রাহিমের কাহিনি, আদম ও হাওয়ার সৃষ্টি, লুতের কাহিনি— সবই বাইবেল, এমনকি বাইবেলের বাইরের অ্যাপোক্রাইফাল (apocryphal) বা লোককাহিনির মতোই। এসব গল্প মুহাম্মদের সময়ে আরব ভূখণ্ডে প্রচলিত ছিল বিভিন্ন ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মুখে মুখে, যা তিনি শুনে নিজের ধর্মীয় আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করেন।

তবে, মুসলিম বিশ্বাসীরা মনে করেন, পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর যেসব অংশ বিকৃত হয়েছিল, কুরআন সেই বিকৃত অংশগুলোর সংশোধনকারী। অন্যদিকে সমালোচকরা বলেন, মুহাম্মদ ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো গ্রহণ করে ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর উপযোগীভাবে রূপান্তর করেছেন।

সবশেষে, এ নিয়ে মানুষের মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক। কেউ এটা দেখেন প্রমাণ হিসেবে যে কুরআন মানব রচিত, আবার কেউ দেখেন একে পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থের পুনঃনির্দেশনা হিসেবে। গবেষণা-ভিত্তিক এই আলোচনার লক্ষ্য ছিল— পাঠকের চিন্তাভাবনায় প্রশ্ন তোলা এবং নিজ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা।

Post a Comment

Previous Post Next Post