ঋষি জাবালি কি নাস্তিক ছিলেন?

 

 

১. ঋষি জাবালিকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত: রামায়ণের মূল ঘটনাটি কী?

ঋষি জাবালিকে নিয়ে নাস্তিকতার প্রশ্নটি প্রধানত আসে রামায়ণের এক বিশেষ অংশ থেকে। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে একটি ঘটনায় দেখা যায়—যখন রাম বনবাসে যাচ্ছেন, তখন কিছু ব্রাহ্মণ ও ঋষি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যাতে তিনি বন না যান। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঋষি জাবালি। তিনি রামকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন এবং সেই অনুরোধের সময় তিনি যে যুক্তিগুলো দেন, তা চমকপ্রদভাবে ধর্মবিরোধী ও বস্তুবাদী মনে হয়।

জাবালি বলেন:

    “তুমি যাকে ‘পিতা’ বলছো, তিনি এখন মৃত। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত বলে ধরে রেখে তার আদেশ পালন করা বোকামি। মৃতদেহ তো কেবল ভস্ম হয়ে যায়—তাতে আর কী রইলো যে তার কথা মানতে হবে? তুমি বনবাসে গিয়ে কেবল কষ্ট পাবে, কিছুই পাবে না।”

এই কথাগুলো থেকে অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, ঋষি জাবালি ছিলেন চার্বাক দর্শনের অনুসারী বা নাস্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই মত কি সত্যিই তার নিজের ছিল, নাকি এর পিছনে ছিল অন্য কোনো কারণ?

২. ঋষি জাবালির বক্তব্য কি চার্বাক দর্শনের সাথে মিলে যায়?

জাবালির যে বক্তব্যটি আমরা রামায়ণে পাই, তা স্পষ্টতই চার্বাক দর্শনের সাথে অনেকটা সাযুজ্যপূর্ণ। চার্বাক হলো প্রাচীন ভারতের একটি বস্তুবাদী ও নাস্তিক দর্শন। এই দর্শনের মূলমন্ত্র ছিল:

    "যাবৎ জীবং সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত।"
    অর্থাৎ – যতদিন বেঁচে আছো, ততদিন আনন্দে বাঁচো; ঋণ করে হলেও ঘি খাও।

চার্বাক দর্শন আত্মা, পরকাল, পুনর্জন্ম—এসব বিশ্বাস করতো না। তাদের মতে মৃত্যুর পরে কিছুই থাকে না, আর ধর্ম বা ত্যাগের নামে দুঃখ ভোগ করার কোনো মানে নেই। এখন, জাবালির বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:

    তিনি বলেছিলেন মৃত ব্যক্তিকে “পিতা” ধরে রেখে তার আদেশ মানা বোকামি।

    মৃত্যুর পরে আর কিছু থাকে না বলে তিনি বনবাসে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেছিলেন।

    জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো ইন্দ্রিয়ভোগ—এই কথাও তার যুক্তির মধ্যে উঠে আসে।

এই যুক্তিগুলো স্পষ্টতই চার্বাক দর্শনের মূলনীতির সাথে মিলে যায়। তাই অনেকে মনে করেন, জাবালি হয়ত এই দর্শনের অনুসারী ছিলেন অথবা অন্তত তার বক্তব্যে চার্বাক প্রভাব ছিল। তবে এর মানে কি তিনি সত্যিই নাস্তিক ছিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের দেখতে হবে—তিনি এসব কথা বলেছিলেন কোন উদ্দেশ্যে।


৩. ঋষি জাবালির বক্তব্য কি প্রকৃত বিশ্বাস, না কৌশল?

এই প্রশ্নের উত্তর রামায়ণের পাঠ বিশ্লেষণ করলে অনেকটাই পরিষ্কার হয়। রাম যখন জাবালির যুক্তিগুলোর পাল্টা জবাব দেন, তখন তিনি বলেন যে এই ধরনের বস্তুবাদী ও ধর্মবিরোধী বক্তব্য সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে। রাম অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এই চিন্তাধারার সমালোচনা করেন।

এরপর জবালি নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে বলেন:

    “আমি এই কথাগুলো বলেছি শুধু তোমাকে বোঝানোর জন্য, যেন তুমি রাজ্যে ফিরে আসো। আমি প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু বিশ্বাস করি না।”

এই বক্তব্যের ফলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, জাবালি নিজে নাস্তিক ছিলেন না; বরং তিনি রাজনীতিক কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক চেষ্টা—রামকে আবেগ দিয়ে না, বরং যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা।

অর্থাৎ, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে চার্বাক দর্শনের যুক্তি ব্যবহার করেন, যদিও তিনি নিজে এই দর্শনের অনুসারী ছিলেন না। অনেকটা আজকের যুগে কোনো যুক্তিবাদী বন্ধুকে বোঝাতে "ধর্মের দৃষ্টিকোণ" ব্যবহার করার মতো কৌশল।

তবে এটা নিয়েও বিতর্ক আছে।

৪. বাল্মীকি কি নিজেই ঋষি জাবালির ভাবমূর্তি সংশোধন করেছেন?

রামায়ণের ব্যাকরণগত ও কাঠামোগত বিশ্লেষণে গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, ঋষি জাবালির বক্তব্যের পর বাল্মীকি একটি অদ্ভুত রকমের “রিপেয়ার” করেছেন। রাম যে কড়া ভাষায় জাবালির বক্তব্য খণ্ডন করেন এবং তারপর জাবালি যে নিজের কথা প্রত্যাহার করেন—এই অংশটিকে অনেকেই মনে করেন "damage control"।

কেন এইরকম একটি কৌশল প্রয়োগ করা হলো?

অনেক গবেষকের মতে, বাল্মীকি বা তার পরবর্তী কোনো সম্পাদক বুঝতে পেরেছিলেন যে জাবালির বক্তব্য অতিমাত্রায় বিতর্কিত এবং নাস্তিকতা প্রচারের মতো শোনাতে পারে। তাই এমন একটা ছাঁকুনির ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে জাবালিকে একদিকে জ্ঞানী ও কৌশলী হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, আবার অন্যদিকে তার ধর্মবিরোধী বক্তব্যকে জাস্টিফাই করা যায়।

এমনকি কিছু সংস্করণে দেখা যায়—রাজা দশরথ যখন দরবারের পণ্ডিতদের রামকে বোঝানোর দায়িত্ব দেন, তখন তাদের মধ্যে “জাবালি” নামটি উল্লেখ করা হয় না। অনেক গবেষক ধারণা করেন, এগুলো বাল্মীকি রামায়ণের বিভিন্ন স্তরের সম্পাদনার প্রমাণ হতে পারে।

এই উপস্থাপনাটির মাধ্যমে বোঝা যায়—জাবালির বক্তব্য অস্বস্তিকর হলেও চরিত্রটি মুছে না দিয়ে বরং পরবর্তীতে তাকে 'অপনোদন' করা হয়েছে। এও হতে পারে—মূলত ঋষি জাবালির চরিত্রের মাধ্যমে সেই সময়কার সমাজে প্রচলিত বস্তুবাদী ও নাস্তিক চিন্তাধারাকে নাটকীয়ভাবে রামায়ণের বিপরীতে উপস্থাপন করা হয়েছে।


৫. ঋষি জাবালির নাস্তিকতা প্রসঙ্গে মনুস্মৃতি ও ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া

রামায়ণে ঋষি জাবালির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া শুধু কাহিনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার বক্তব্য ব্রাহ্মণ্য সমাজে একটি “আদর্শহীন” দর্শনের পরিচয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন আমরা পাই মনুস্মৃতিতে, যেখানে “নাস্তিকতা” এবং বিশেষ করে “চার্বাক” মতবাদকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে।

মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:

    "নাস্তিক্যং দৃষ্টিপূর্বকং, বেদবাহ্যং প্রবর্ততে।"
    অর্থাৎ – নাস্তিক্যবাদ বেদবিরোধী এবং সমাজের জন্য হানিকর।

এই প্রেক্ষাপটে অনেক পুরাতন পণ্ডিত ও ধর্মগুরুদের মত ছিল—জাবালির মতো ব্যক্তিদের বক্তব্য সমাজকে ধর্মচ্যুত করতে পারে। তাই তাকে 'নাস্তিক' বা 'চার্বাক' বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে একধরনের সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হয়।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠে আসে—

ঋষি জাবালি যদি সত্যিই নাস্তিক হতেন, তাহলে তিনি একজন ব্রাহ্মণ ও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ ঋষি হিসেবে কিভাবে নিজের অবস্থান ধরে রাখলেন?

এটি থেকেই অনেক গবেষক মনে করেন, তাকে নাস্তিক বলা আদৌ সঠিক নয়—বরং তার যুক্তি ও কৌশল ধর্মীয় অনুগততায় না গিয়ে যৌক্তিকতা ও বাস্তবতায় দাঁড় করানোর একটি প্রয়াস ছিল। সম্ভবত তিনি ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে না গিয়ে, কাঠামোর ভেতর থেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।

৬. আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঋষি জাবালির অবস্থান বিশ্লেষণ

আধুনিক যুক্তিবাদী ও নাস্তিক চিন্তাবিদদের কাছে ঋষি জাবালির বক্তব্য এক ধরনের দার্শনিক বিপ্লবের ইঙ্গিত বহন করে। ভারতে প্রাচীনকাল থেকে যে ধর্মীয় অনুশাসন ও পুনর্জন্ম, আত্মা, পুণ্য, পাপ ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজ পরিচালিত হয়েছে, সেখান থেকে এক ব্যক্তি যখন বলেন “মৃতদের কথা শুনে জীবিতরা কষ্ট ভোগ করবে কেন?”, তখন সেটি নিঃসন্দেহে প্রথাবিরোধী ও বিপ্লবাত্মক।

আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—

    জাবালি একটি ক্রিটিকাল থিংকিং-এর মডেল উপস্থাপন করেছিলেন, যেখানে তিনি রামকে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বলেন—যে সিদ্ধান্ত পুরোটাই আবেগ ও কর্তব্যবোধ দ্বারা চালিত।

    তিনি ধর্মীয় অনুশাসন ও প্রথার মধ্যকার যুক্তিহীনতাকে তুলে ধরেন, যা আজকের দুনিয়ায় ধর্মীয় সংস্কারবাদীদেরও প্রেরণা হতে পারে।

    তার কথাবার্তা ছিল সেক্যুলার ও বাস্তবতাবাদী, যেখানে মৃত্যুর পরে কী আছে সেটা নিয়ে ভেবে নয়, বরং জীবনের দায়িত্ব ও বাস্তবতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দেওয়া হয়।

আধুনিক যুক্তিবাদীরা জাবালির এই অবস্থানকে “proto-atheism” বা প্রাথমিক স্তরের নাস্তিকতার প্রকাশ হিসেবে দেখেন। যদিও তিনি সরাসরি ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি, তবে ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্বকে প্রাসঙ্গিক মনে করেননি—এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

অন্যদিকে, রক্ষণশীল ধর্মপ্রাণরা এখনও তাকে 'সন্দেহজনক' চরিত্র বলে মনে করেন। ফলে জাবালি একজন ধ্রুপদী বিতর্কিত চরিত্র, যাকে একদিকে যুক্তিবাদের প্রতীক বলা যায়, আবার অন্যদিকে ধর্মীয় কৌশলের এক জটিল মুখপাত্রও বলা চলে।

৭. উপসংহার: ঋষি জাবালি কি সত্যিই নাস্তিক ছিলেন?

ঋষি জাবালিকে নাস্তিক বলা যায় কি না, তার নির্দিষ্ট উত্তর ইতিহাস বা সাহিত্য সরাসরি দেয় না। তবে তার চরিত্র ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণায় পৌঁছাতে পারি—

    তিনি কি চার্বাক ছিলেন?—সম্ভবত না। যদিও তার বক্তব্য চার্বাক দর্শনের সাথে মিল রয়েছে, কিন্তু তিনি নিজে বলেছেন, এসব তিনি রামকে বোঝানোর কৌশল হিসেবে বলেছিলেন।

    তিনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন?—এ বিষয়ে কোনো সরাসরি বক্তব্য নেই, তবে তার যুক্তির প্যাটার্ন বলে যে তিনি আত্মা-পুনর্জন্ম-পরকালকে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য মানতেন না।

    তিনি কি নীতিহীন ছিলেন?—না, বরং তিনি এক বিশেষ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই রামকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, নিজের জীবনের গুরুত্ব, রাজ্য ও জনতার কল্যাণ প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

    তিনি কি সাহসী ছিলেন?—নিঃসন্দেহে। ধর্মীয় প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরা, এবং একজন আদর্শবাদী রাজপুত্রকে অন্যভাবে চিন্তা করতে বলা, নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ মননের পরিচয়।

ফলে উপসংহারে বলা যায়: ঋষি জাবালি ছিলেন না সরলভাবে “নাস্তিক” বা “আস্তিক”—তিনি ছিলেন এক “সন্দেহপ্রবণ যুক্তিবাদী”। তিনি ছিলেন সেই প্রাচীন যুগের একজন বিরল দার্শনিক, যিনি যুক্তির ভাষায় ধর্ম, কর্তব্য, ও সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।

এই কারণেই জাবালির নাম আমাদের মনে রাখা উচিত—শুধু একটি বিতর্কের প্রতীক হিসেবে নয়, বরং প্রাচীন ভারতের দর্শনের বহুমাত্রিকতাকে বোঝার একটি জানালা হিসেবেও।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post