১. কুরআনের সংকলন: মুহাম্মদের মৃত্যুর আগে কী ছিল?
মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে, মুহাম্মদ যখন জীবিত ছিলেন, তখন কুরআন সম্পূর্ণরূপে লিখিত অবস্থায় একত্রিত ছিল না। মুহাম্মদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আয়াত বলতেন, এবং তা কেউ মুখস্থ করে রাখত, কেউ খেজুর পাতায়, চামড়ায়, পাথরে কিংবা হাড়ে লিখে রাখত। এইসব টুকরো টুকরো কুরআনের অংশ বিভিন্ন সাহাবিদের কাছে ছড়িয়ে ছিল।
কুরআনকে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ মুহাম্মদের জীবদ্দশায় নেওয়া হয়নি। এমনকি কুরআনের আয়াতগুলোর সঠিক সিকোয়েন্সও নির্ধারিত ছিল না—তাকে মুহাম্মদ কখনো বলেননি যে, কোন আয়াত কোন সূরার কোথায় বসাতে হবে। ফলে সংকলনের প্রশ্নে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে সাহাবিদের মধ্যকার মতবিরোধ থেকেই।
হাদীসগ্রন্থ সাহিহ বুখারিতে জায়েদ ইবনে সাবিত বর্ণনা করেন:
"আবু বকর আমাকে বললেন, ‘যুদ্ধে অনেক ক্বারী (কুরআন মুখস্থকারী) শহীদ হয়েছেন। আমি আশঙ্কা করছি, যদি কুরআন একত্র না করা হয় তবে তার একটি বড় অংশ হারিয়ে যাবে।’"
— সহিহ বুখারী, কিতাবুল জামি‘ আল-কুরআন, হাদীস: ৪৯৮৬
এই উদ্ধৃতিতে বোঝা যায়, কুরআন সংকলন ছিল সাহাবিদের একটি মানবিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, যেটি মুহাম্মদের নির্দেশনায় হয়নি।
২. সাহাবিদের মাঝে কুরআনের পাঠভেদ ও ভুলে যাওয়ার হাদীস
মুসলিম ঐতিহাসিক সূত্র ও হাদীসগ্রন্থগুলোতে বহুবার উল্লেখ আছে যে সাহাবিদের মধ্যে কুরআনের আয়াত, সূরা, এমনকি কুরআনের আয়াতসংখ্যা নিয়েও মতবিরোধ ছিল। কেউ কেউ একে ‘সাত হারফ’ বা ‘সাত ধরণের পাঠভঙ্গি’ বললেও, প্রকৃতপক্ষে এসব পাঠভেদের মধ্যে অনেক গুরুতর পার্থক্য ছিল।
ক. সুরা আহজাব ছিল সূরা বাক্বারার মতো বড়?
সুরা আহজাব বর্তমান কুরআনে মাত্র ৭৩টি আয়াতের, কিন্তু একটি সহিহ হাদীসে উল্লেখ আছে—
"সুরা আহজাবের আয়াতসমূহ সুরা বাক্বারার সমান ছিল, আমি তা পড়তাম কিন্তু এখন তা হারিয়ে গেছে।"
— মুসনাদ আহমদ, হাদীস: ২১০২২
সুরা বাক্বারার আয়াতসংখ্যা ২৮৬। অর্থাৎ উক্ত হাদীস অনুযায়ী প্রায় ২০০টিরও বেশি আয়াত সুরা আহজাব থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। এটি খুবই গুরুতর প্রশ্ন তোলে কুরআনের সংরক্ষণ সম্পর্কে।
খ. সাহাবি উবাই ইবনে কাবের ভিন্ন কুরআন
বিখ্যাত সাহাবি উবাই ইবনে কাব ছিলেন মুহাম্মদের অন্যতম ক্বারী। তবে তাঁর কুরআনের পাঠ্য অনেক জায়গায় অন্যান্যদের থেকে ভিন্ন ছিল। উবাইয়ের মুসহাফে কিছু অতিরিক্ত সূরা ছিল, যেমন—
সূরা খাল
সূরা হাফদ
(এই দুটি সূরার অস্তিত্ব সহিহ হাদীসে পাওয়া যায় না, কিন্তু সাহাবিদের বর্ণনায় এসেছে।)
গ. সূরা রজম (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা) হারিয়ে গেছে?
উমর ইবনে খাত্তাবের একটি সুপরিচিত বর্ণনা রয়েছে:
“যদি লোকেরা না বলে যে, উমর কুরআনে এমন কিছু যোগ করেছেন যা সেখানে নেই, তবে আমি ‘রজম’ আয়াতটি কুরআনে অন্তর্ভুক্ত করতাম।”
— সহিহ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, হাদীস: ৬৮৩০
তিনি বলেছিলেন, কুরআনে একটি আয়াত ছিল:
"الشيخ والشيخة إذا زنيا فارجموهما البتة نكالاً من الله"
(“যদি বৃদ্ধ পুরুষ ও বৃদ্ধ নারী ব্যভিচার করে, তবে তাদের পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা কর।”)
এই আয়াতটি কুরআনে নেই, অথচ উমর দাবি করেছেন এটা কুরআনের অংশ ছিল এবং এখন লুপ্ত।
ঘ. আয়াত ভুলে যাওয়ার ঘটনা
একটি সহিহ হাদীসে এসেছে:
“রাসুল (মুহাম্মদ) বললেন, আমি গতকাল একটি সূরা মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি।”
— সহিহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত, হাদীস: ৫০০
এটি দেখায়, মুহাম্মদ নিজেই কিছু আয়াত ভুলে যেতেন, যা প্রশ্ন তোলে: এই আয়াতগুলো সংরক্ষিত হলো কীভাবে?
এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণ একটি জটিল মানবিক প্রক্রিয়া ছিল, যেটাতে মতবিরোধ, ভুলে যাওয়া এবং পাঠভেদ ছিল খুবই স্বাভাবিক।
৩. কুরআনের সংকলনের রাজনীতি: উসমান ও পাঠভেদ দমন
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর কুরআনের সংকলন যে একাধিক সাহাবি আলাদাভাবে করছিলেন, তা ইতিহাসে বারবার উঠে এসেছে। কেউ কেউ নিজস্ব মুসহাফ তৈরি করেছিলেন, যার পাঠভঙ্গি (recitation style) ও আয়াত বিন্যাস ছিল আলাদা। যখন মুসলিম সাম্রাজ্য প্রসারিত হতে থাকে, তখন বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা একে অপরের কুরআনের পাঠকে ভুল বলে দাবি করতে শুরু করে। এই বিভ্রান্তি নিরসনে উসমান ইবনে আফফান সিদ্ধান্ত নেন একটি ‘সরকারি সংস্করণ’ তৈরির।
ক. উসমানের উদ্যোগ: কুরআনের একক সরকারিভাবে অনুমোদিত সংস্করণ
উসমান জায়েদ ইবনে সাবিত এবং অন্যান্য কয়েকজন ক্বারীকে নিযুক্ত করেন সরকারি মুসহাফ প্রস্তুতের জন্য। এর উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট পাঠভঙ্গিকে মান্যতা দেওয়া এবং অন্যান্য পাঠকে বাতিল ঘোষণা করা।
“উসমান বললেন, ‘তোমরা যদি কুরআনের কোনো বিষয়ে জায়েদ ও কুরাইশি অন্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখতে পাও, তবে তা কুরাইশি ভাষায় লিখো, কেননা কুরআন তাদের ভাষাতেই অবতীর্ণ হয়েছে।’”
— সহিহ বুখারী, হাদীস: ৪৯৮৭
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে, কুরআনের ভাষাগত ও পাঠগত ভিন্নতা ছিল এতটাই স্পষ্ট যে, সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়।
খ. অন্যান্য সাহাবিদের কুরআন পুড়িয়ে ফেলা
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় ছিল, উসমান নিজের নির্ধারিত সংস্করণ ছাড়া বাকি সব কপি জ্বালিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। বহু ইতিহাসবিদ, যেমন ইবনে আবি দাউদ (মৃত্যু: ৩১৬ হিজরি), তার বিখ্যাত “কিতাবুল মাসাহিফ”-এ এই ঘটনা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।
“উসমান কুরআনের অন্য সব কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেন।”
— ইবনে আবি দাউদ, কিতাবুল মাসাহিফ, পৃষ্ঠা: ২৩
এই পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিকভাবে নজিরবিহীন, কারণ এটি কেবল একটি ধর্মগ্রন্থের পাঠকে নিয়ন্ত্রণ করতেই নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ঐক্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবেও কাজ করে।
গ. সাহাবিদের মধ্যে বিরোধ
উসমানের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক সাহাবি অখুশি হয়েছিলেন। যেমন:
ইবনে মাসউদ, যিনি ছিলেন মুহাম্মদের কাছের ক্বারীদের একজন, তিনি জায়েদ ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে হওয়া সংকলনকে ‘ভুয়া’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
তার মুসহাফে ছিল না সূরা ফাতিহা এবং সূরা ফালাক-নাস, আবার কিছু আয়াত ছিল যা অন্য সাহাবিদের কপিতে অনুপস্থিত ছিল।
এই বিরোধ এতটাই তীব্র ছিল যে ইবনে মাসউদ সরকারিভাবে নিযুক্ত পাঠভঙ্গি মানতে অস্বীকৃতি জানান।
ঘ. ফলাফল: একক পাঠ, কিন্তু ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি
উসমানের সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি একক কুরআনের রূপ দিলেও, এর মাধ্যমে কুরআনের বিকল্প পাঠ ও ইতিহাস হারিয়ে যায়। আজ যে কুরআন আমরা দেখি, তা মূলত উসমানিক পাঠ, কিন্তু এর পেছনে যে বিতর্ক, মতভেদ, এবং রাজনীতি ছিল—তা সাধারণ মুসলিমরা জানেই না।
এই অংশের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, কুরআনের সংকলন ছিল কেবল একটি আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে গড়ে ওঠা একটি মানবিক প্রচেষ্টা।
৪. উপসংহার: কুরআনের ঐতিহাসিকতাকে কীভাবে বোঝা উচিত?
কুরআনকে নিয়ে মুসলিম সমাজে যে ধারণাটি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত, তা হলো—এটি একেবারে অক্ষতভাবে সংরক্ষিত, কোনো পরিবর্তন বা ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়নি। তবে ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণের পেছনে ছিল জটিল মানবিক প্রক্রিয়া, মতবিরোধ, ভুলে যাওয়া, পাঠভেদ, এমনকি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
ক. কুরআনের সংরক্ষণ ছিল ধাপে ধাপে, মানুষ-নির্ভর
মুহাম্মদের সময়ে কুরআন লিখিতভাবে পূর্ণাঙ্গ আকারে সংরক্ষিত ছিল না। আয়াতগুলো বিভিন্ন কাঁধের হাড়, চামড়া, পাথর, পাতায় লেখা হতো এবং অনেক সাহাবির মুখস্থ ভরসাতেই ছিল এই গ্রন্থ। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর অনেক হাফিজ সাহাবি যুদ্ধে মারা গেলে হুজাইফা ইবনে ইয়ামানের অনুরোধে প্রথম খলিফা আবু বকর সংকলনের উদ্যোগ নেন। এটি ছিল প্রথম সরকারিভাবে কুরআন সংকলনের প্রচেষ্টা, যার নেতৃত্বে ছিলেন জায়েদ ইবনে সাবিত। কিন্তু এ-ও ছিল কেবল একটি প্রাথমিক রূপ।
খ. মতবিরোধ কেবল উচ্চারণ বা রেওয়ায়েতে নয়, বরং আয়াতসংখ্যা ও সূরা নিয়ে
সুরা আহজাবের আয়াত হারানো, রজম আয়াত বাদ যাওয়া, সূরা ফাতিহা ও সূরা নাস ইবনে মাসউদের মুসহাফে অনুপস্থিত থাকা—এসব ইঙ্গিত দেয়, পাঠভেদ শুধু উচ্চারণে ছিল না, বরং পাঠ্যবস্তুতেও গুরুতর ফারাক ছিল।
গ. সংকলন ও সংরক্ষণের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
উসমানের সিদ্ধান্ত—একক কুরআন পাঠ প্রণয়ন এবং বাকি সব কপি ধ্বংস—এই বাস্তবতা তুলে ধরে যে কুরআনের সংকলন ছিল রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক কৌশল। এটি নিছক ধর্মীয় অনুশীলন ছিল না, বরং একটি সাম্রাজ্যের একীকরণও ছিল।
ঘ. ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আজ যারা কুরআনকে প্রশ্নাতীত, অদ্বিতীয় ও “আসমান থেকে অবিকৃতভাবে নাযিল” বলে মনে করেন, তাদের জন্য এসব ইতিহাস অস্বস্তিকর হতে পারে। কিন্তু সত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও অনুসন্ধানের পথ ছেড়ে দিলে বিশ্বাস হয়ে পড়ে অন্ধ আনুগত্য।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআনকে বুঝলে আমরা বুঝতে পারি—
এটি একটি দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হওয়া গ্রন্থ,
যেখানে মানুষ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভাষার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ,
এবং এর বর্তমান রূপ আসলে বহু সংকলনের পর নির্ধারিত হয়েছে।
ঙ. আমাদের করণীয় কী?
প্রথমত, কুরআনকে বুঝতে হলে কেবল ধর্মীয় আবেগ দিয়ে নয়, বরং ইতিহাস, ভাষাবিজ্ঞান ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের চোখ দিয়ে দেখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বুঝতে হবে যে সত্যকে জানতে হলে প্রশ্ন করতে হবে—আর প্রশ্ন কখনও ঈমান নষ্ট করে না, বরং তাকে পরিশুদ্ধ করে।
শেষ কথা:
কুরআনের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে জানলে আমরা কুরআনের মূল্য ও প্রভাবকে ছোট করি না। বরং বুঝতে পারি—একটি ধর্মগ্রন্থের গঠনে মানব, সমাজ ও রাজনীতির অবদান কত গভীর ও জটিল।
কুরআনকে প্রশ্ন করতে শেখো, সত্যকে জানতে শেখো। ধর্মান্ধতা নয়, অনুসন্ধান হোক লক্ষ্য।