বাইবেলের ঈশ্বর: নিষ্ঠুর শাসক না করুণাময় পিতা?

 


 

ভূমিকা:
বাইবেল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মগ্রন্থগুলোর একটি। এর মধ্যে রয়েছে দুইটি প্রধান অংশ—পুরাতন নিয়ম (Old Testament) ও নতুন নিয়ম (New Testament)। অনেক পাঠক ও বিশ্লেষক লক্ষ্য করেছেন যে, এই দুই অংশে ঈশ্বরের চরিত্র একেবারে ভিন্ন। পুরাতনে তিনি নৃশংস, রক্তপিপাসু ও কঠোর শাসক, যেখানে নতুন নিয়মে তিনি করুণাময়, প্রেমময় ও ক্ষমাশীল। এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করব—

    এই পার্থক্য কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে,

    এর পিছনের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক পটভূমি কী,

    এবং এর নৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য কী।

পয়েন্ট ১: পুরাতন নিয়মের ঈশ্বর—এক নিষ্ঠুর সেনাপতি
বাইবেলের পুরাতন নিয়মে ঈশ্বরকে প্রায়শই দেখা যায় একজন যুদ্ধপ্রিয়, শাস্তিদানকারী ও জাতিগত নির্মূলনকারী হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ:

    1 Samuel 15:3 – "Now go and smite Amalek, and utterly destroy all that they have, and spare them not; but slay both man and woman, infant and suckling, ox and sheep, camel and ass."
    অর্থাৎ, শিশু, নারী, পশু—কাউকে ছাড় না দিতে আদেশ করা হয়েছে। এটা কি একজন দয়াময় ঈশ্বরের কাজ?

   * Deuteronomy 20:16-17 – "But of the cities of these people... thou shalt save alive nothing that breatheth."

এইসব আদেশ আধুনিক দৃষ্টিতে গণহত্যা বা ethnic cleansing বলে বিবেচিত হবে। এভাবে ঈশ্বরের ইমেজ একটি নিষ্ঠুর সামরিক কমান্ডারের মতো হয়ে ওঠে।

এই জায়গায় প্রশ্ন আসে—এই ঈশ্বর কি ভালো এবং ন্যায়পরায়ণ? নাকি কেবল একটি প্রাচীন যুদ্ধপ্রবণ জনগোষ্ঠীর সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র?


পয়েন্ট ২: নতুন নিয়মের ঈশ্বর—দয়াশীল পিতা ও প্রেমের প্রতীক
নতুন নিয়মে, বিশেষ করে যীশুর মুখে ঈশ্বরের যে চিত্র উঠে আসে, তা সম্পূর্ণ বিপরীত:

    1 John 4:8 – “God is love.”
    এখানে ঈশ্বর হলেন প্রেমের সারাংশ, যিনি সবকিছুর উর্ধ্বে মানবজাতিকে ভালোবাসেন।

    Matthew 5:44 – “But I say unto you, Love your enemies, bless them that curse you…”
    যীশু শত্রুর প্রতিও প্রেম ও ক্ষমা প্রদর্শনের শিক্ষা দেন। পুরাতনে যেখানে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে বলা হয়, সেখানে নতুন নিয়মে তাদের জন্য প্রার্থনার কথা বলা হচ্ছে।

    Luke 15:11-32 (The Prodigal Son) – ঈশ্বরকে দেখানো হয়েছে এমন এক পিতা হিসেবে, যিনি তার ভুলপথে যাওয়া পুত্রকেও ক্ষমা করেন এবং গ্রহণ করেন।

এখানে ঈশ্বর কঠোর শাস্তিদাতা নয়, বরং ক্ষমাশীল অভিভাবক। তিনি প্রেম, করুণা এবং আত্মবলিদানের আদর্শ রূপ।

এই পরিবর্তিত ঈশ্বরচিত্র খ্রিষ্টধর্মকে একটি মানবিক ধর্মে পরিণত করেছে, যার মাধ্যমে পরবর্তীতে উদার মানবতাবাদের জন্ম হয়েছে।

তুলনা করলে দেখা যায়:

    পুরাতনে ঈশ্বর শত্রুদের হত্যা করতে বলেন।

    নতুন নিয়মে তিনি শত্রুদের ভালবাসতে বলেন।
    এটা কেবল দুটি মনোভাবের পার্থক্য নয়, বরং ঈশ্বরের চরিত্রের দুই বিপরীত মেরু।


পয়েন্ট ৩: এই পার্থক্যের পেছনে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ঈশ্বরের এই বিপরীত চিত্র শুধুই ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিষয় নয়—এর পেছনে রয়েছে স্পষ্ট ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রভাব।

    পুরাতন নিয়মের প্রেক্ষাপট: এটি লিখিত হয়েছে এক যাযাবর, যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ইসরায়েলি জনগোষ্ঠীর হাত ধরে, যারা প্রায়শই অন্য জাতির আক্রমণে জর্জরিত হতো। তাদের জন্য ঈশ্বর ছিলেন এক যুদ্ধনেতা, যিনি তাদের বাঁচাতে শত্রুদের ধ্বংস করেন।
    ধর্ম এখানে তাদের জাতীয়তাবাদ ও আত্মরক্ষার হাতিয়ার ছিল।

    নতুন নিয়মের প্রেক্ষাপট: নতুন নিয়ম রোমান শাসনের অধীনে জন্ম নেয়, যেখানে ইহুদি জাতি একটি পরাধীন গোষ্ঠী। এখানে অস্ত্রধারণ করে বিদ্রোহ করলে নির্মূল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই যীশুর শিক্ষা—"অহিংসা", "ক্ষমা", "দয়া"—একটি রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলও ছিল।

উদাহরণস্বরূপ:

    "Turn the other cheek" (Matthew 5:39) – শত্রুর সামনে প্রতিশোধ না নিয়ে সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের শিক্ষা।

    "Give unto Caesar what is Caesar's" (Matthew 22:21) – রোমান শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতে বলা।

এই পার্থক্য দেখায়:
ঈশ্বরের চরিত্র কেবল ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নয়, বরং সমাজের রাজনৈতিক অবস্থা ও সংগ্রামের উপরও নির্ভরশীল।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়—ঈশ্বর আসলে এক জনগোষ্ঠীর মানসিক চাহিদার প্রতিচ্ছবি।


পয়েন্ট ৪: নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ—ঈশ্বর কি আদর্শ নৈতিকতা উপস্থাপন করেন?
যদি ঈশ্বরকে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও ন্যায়পরায়ণ বলা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে—পুরাতন নিয়মের ঈশ্বর কীভাবে শিশু হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ বৈধতা এবং দাসত্বকে সমর্থন করতে পারেন?

কিছু স্পষ্ট উদাহরণ:

    Hosea 13:16 – "Samaria shall become desolate; for she hath rebelled against her God: they shall fall by the sword: their infants shall be dashed in pieces, and their women with child shall be ripped up."
    অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পেট ফাটিয়ে ফেলার নির্দেশ—একটি বর্বরতার নিদর্শন।

    Exodus 21:20-21 – দাসকে মারা হলেও যদি সে এক-দুদিন বেঁচে থাকে, তাহলে মালিককে শাস্তি দেওয়া হবে না।
    এই নিয়ম দাসপ্রথার বৈধতা দেয়।

    Numbers 31:17-18 – মাদিয়ানদের নারীদের ও শিশুদের মেরে ফেলে কুমারী মেয়েদের নিজেদের জন্য রেখে দিতে আদেশ করা হয়।
    এটা শিশুদের হত্যার পাশাপাশি যৌনদাসীতে রূপান্তরের বৈধতা প্রদান করে।

এই সবই একটি আধুনিক নৈতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিন্দনীয়। তাহলে প্রশ্ন উঠে—এই ঈশ্বর কি সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় ও নৈতিকতার প্রতীক?

অপরদিকে, নতুন নিয়মের ঈশ্বর—বিশেষ করে যীশুর মাধ্যমে—নতুন এক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আনেন:

    শত্রুদের ভালোবাসা

    গরীব ও নিপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতি

    ক্ষমা ও আত্মত্যাগ

তুলনা করলে:

    পুরাতনে ঈশ্বর নিজেই নৈতিকতার লঙ্ঘন ঘটান।

    নতুন নিয়মে ঈশ্বর (যীশু) নৈতিকতার এক নতুন উচ্চতা উপস্থাপন করেন।

এখানে প্রশ্ন হলো: ঈশ্বর কি পরিবর্তনশীল? নাকি আমরা বিভিন্ন সময়ে ঈশ্বরকে নিজের মতো করে কল্পনা করেছি?


পয়েন্ট ৫: ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া—খ্রিস্টানদের ব্যাখ্যায় এই বৈপরীত্য কিভাবে মোকাবিলা করা হয়?
বাইবেলের ঈশ্বরের এই দ্বৈত চরিত্র নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে বহু মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে চেষ্টা করেছেন পুরাতন ও নতুন নিয়মের ঈশ্বরকে মিলিয়ে দেখানোর। তবে সেই ব্যাখ্যাগুলো কতটা যুক্তিসঙ্গত? চল দেখি—
১. "ঈশ্বর কখনোই বদলান না, তিনি একই থাকেন" (Malachi 3:6)

অনেক খ্রিস্টান বলেন, ঈশ্বর সর্বদা একই, তাঁর দয়া ও ন্যায় একে অপরের বিপরীত নয়।
তাদের মতে, পুরাতনে ঈশ্বর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন, আর নতুন নিয়মে তার দয়াশীল দিক প্রকাশ পায়।

সমস্যা:

    যদি ঈশ্বর অপরিবর্তনীয় হন, তবে তিনি কেন একদিকে শিশু হত্যা করেন, অন্যদিকে শত্রুদের ভালোবাসার শিক্ষা দেন?

    এটা কি নৈতিক দ্বিচারিতা নয়?

২. "পুরাতন নিয়ম ছিল আইন ও বিচার, নতুন নিয়ম হল করুণা ও বিশ্বাস"

অনেকে বলেন, পুরাতন নিয়মে মানুষ ঈশ্বরের আইন মেনে চলত, কিন্তু যীশুর আগমনের পর ঈশ্বর করুণা ও আত্মত্যাগের পথ দেখান।

সমস্যা:

    তাহলে কি ঈশ্বর নিজেই আগে অন্যায় পন্থা দেখিয়েছিলেন?

    আর যদি যীশু আসার পর ন্যায় ও ভালোবাসা শেখানো হয়, তবে আগে কি মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে?

৩. "ঈশ্বর আমাদের বোঝার ক্ষমতা ছাড়িয়ে যান"

এই যুক্তি প্রায়ই ব্যবহার করা হয় যখন ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়—"তিনি যা করেন, তার পেছনে উচ্চতর পরিকল্পনা আছে।"

সমস্যা:

    এই যুক্তি দিয়ে Hitler বা Pol Pot-এরও কাজকে ‘ঊর্ধ্বতন পরিকল্পনা’ বলে চালানো যায়।

    যদি ঈশ্বর বিচার্য নন, তবে কেন তাকে ন্যায়পরায়ণ বলা হয়?

এই ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলি অনেক সময় ঈশ্বরের নিষ্ঠুর কাজগুলোকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে নৈতিক দ্বিধা তৈরি করে।


পয়েন্ট ৬: দার্শনিক বিশ্লেষণ—ঈশ্বর কি একটি নৈতিকভাবে নির্মিত কল্পনা?
দার্শনিকেরা বহু বছর ধরেই ধর্মীয় গ্রন্থে ঈশ্বরের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। তাদের মতে, ঈশ্বরের চিত্র বিভিন্ন সময়ে মানুষের নৈতিক চেতনা, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়েছে।
১. Nietzsche-এর দৃষ্টিভঙ্গি:

Friedrich Nietzsche বলেন,

    “God is a projection of human values.”
    অর্থাৎ, ঈশ্বর মানবজাতিরই একটি মানসিক প্রতিচ্ছবি। যখন সমাজ হিংস্র ও যুদ্ধবাজ ছিল, তখন ঈশ্বরও ছিলেন নির্মম। কিন্তু সমাজ যখন উন্নত ও মানবিক হলো, ঈশ্বরও হয়ে উঠলেন দয়ালু।

২. Epicurus-এর নৈতিক আপত্তি:

    “If God is willing to prevent evil but not able, then he is not omnipotent.
    If he is able but not willing, then he is malevolent.
    If he is both able and willing, then why is there evil?”
    এই ত্রিভুজ প্রশ্ন ঈশ্বরের প্রকৃতি ও বাস্তবতার মধ্যে বৈপরীত্যকে চিহ্নিত করে।

৩. ঈশ্বর কি আদৌ বিদ্যমান, না কি নৈতিক ধারণা কেবল মানবসৃষ্ট?

অনেকে যুক্তি দেন—আমরা যে ঈশ্বরকে ভালোবাসি, তিনি আসলে আমাদের কল্পনার ঈশ্বর। কারণ, যদি বাইবেলের ঈশ্বর সত্যিকারের ঈশ্বর হতেন, তাহলে তার আচরণ হতে পারত না—

    শিশু হত্যা,

    নারীদের ধর্ষণ বৈধতা,

    দাসত্বের অনুমোদন,

    এবং একইসাথে শত্রুদের ভালোবাসার শিক্ষা!

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়:
ঈশ্বরের চরিত্র—চিরন্তন, সার্বভৌম বা নৈতিকতার আধার—এই সবগুলো ধারণাই আসলে মানুষের মননশীলতার ফসল।


পয়েন্ট ৭: উপসংহার—দয়াময় নাকি নিষ্ঠুর? ঈশ্বরের দ্বৈত চিত্রের অন্তরালের বাস্তবতা
বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের ঈশ্বর যেন দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। একদিকে তিনি নৃশংস ও রক্তপিপাসু, অন্যদিকে তিনি দয়াবান ও ক্ষমাশীল। এই দ্বৈততা শুধুই ধর্মীয় ব্যাখ্যা নয়—এটি প্রকাশ করে মানুষের সমাজ, রাজনীতি, নৈতিকতা ও মানসিকতার পরিবর্তন।
সারসংক্ষেপ:

    ঐতিহাসিকভাবে, পুরাতন নিয়মের ঈশ্বর গঠিত হয়েছেন যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ইসরায়েলি জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

    রাজনৈতিকভাবে, নতুন নিয়মে যীশুর শিক্ষা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে টিকে থাকার কৌশল।

    নৈতিকভাবে, পুরাতন নিয়মে ঈশ্বর অনেক কাজ করেন যা আজকের বিবেচনায় অমানবিক। নতুন নিয়মে তিনি আদর্শ মানবিকতা শেখান।

    দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব, এই দ্বৈত চিত্রকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু এতে ঈশ্বরের নৈতিকতা ও সার্বভৌমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

    দার্শনিকভাবে, ঈশ্বর আসলে মানবজাতির মানসিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রক্ষেপণ মাত্র—প্রতিটি যুগে মানুষ নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী ঈশ্বরকে নির্মাণ করে।

তাহলে প্রশ্ন থাকে—

ঈশ্বর কি আদৌ কোনো চিরন্তন সত্তা?
নাকি তিনি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল চাহিদার প্রতিফলন?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঈশ্বরকে আমরা যেমন কল্পনা করি, তা নির্ধারণ করে আমরা কেমন সমাজ গড়ে তুলব—মানবিক না বর্বর।

2 Comments

  1. Wazad Bhai, Apni onek valo likhen. -Kushim

    ReplyDelete
  2. Vai, Ei Movie ta sompurno dekhen, Somoi na pele Prothon "Religion" Ongso dekhen.
    https://archive.org/details/zeitgeist_movie

    ReplyDelete
Previous Post Next Post