স্যাটানিক ভার্সেস বা শয়তানের আয়াত: ইতিহাস, বিতর্ক ও সত্যতার অনুসন্ধান

স্যাটানিক ভার্সেস: হারুন রুশদির বই, বিতর্ক ও বাস্তবতা

স্যাটানিক ভার্সেস: হারুন রুশদির বই, বিতর্ক ও বাস্তবতা

1. ভূমিকা

হারুন রুশদির "The Satanic Verses" উপন্যাসটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র বিতর্ক ও সহিংস প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বইটি শুধু একটি সাহিত্যিক সৃষ্টি নয়; বরং ধর্মীয় অনুভূতি, ইতিহাস, কল্পনা এবং রাজনৈতিক বিতর্কের এক বিস্ফোরক মিশ্রণ। এটি ইসলাম, মুহাম্মদ ও কুরআনের কিছু ঘটনাকে কাল্পনিক রূপে উপস্থাপন করে, যার কারণে বহু মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।

2. শয়তানের আয়াতের মূল ঘটনা

বইটির বিতর্কিত অংশের কেন্দ্রবিন্দু হল একটি ঘটনাকে ঘিরে, যেখানে ইসলামি ঐতিহাসিক কিছু তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয় যে, মুহাম্মদ শয়তানের প্ররোচনায় কিছু আয়াত পাঠ করেছিলেন যা পরবর্তীতে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এগুলোকেই বলা হয় “শয়তানের আয়াত” বা “The Satanic Verses”। এই ঘটনাটি মূলত ইসলামি ঐতিহ্যের কিছু প্রাচীন বইয়ে আলোচিত হয়েছে, যদিও পরবর্তীতে অনেক আলেম এই ঘটনাকে “বানোয়াট” বা “জাল” বলে ঘোষণা করেছেন।

3. শয়তানের প্রভাবে নবীগণ

ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য আছে, নবীরা কি শয়তানের প্রভাবে পড়তে পারেন? কুরআনে বলা হয়েছে, প্রতিটি নবীর কাছে শয়তান কিছু কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করেছে (সূরা হজ্জ: ৫২)। এই আয়াতের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই “শয়তানের আয়াত” এর ঘটনার উৎস খোঁজা হয়। তবে অধিকাংশ আলেম বিশ্বাস করেন, মুহাম্মদ কখনও শয়তানের প্রভাবে কোরআনের অংশ বলেননি।

4. নবীর গালাগালি, কটূক্তি, সমালোচনা

রুশদির বইতে কিছু চরিত্র ও ঘটনার মাধ্যমে মুহাম্মদ এবং তাঁর স্ত্রীদের ব্যঙ্গ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। “মাহাউন্দ” নামের একটি চরিত্র, “জাহিলা” নামের শহর, এবং কিছু নারীর নাম দিয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মুহাম্মদের স্ত্রীদের প্রতি। এ কারণে মুসলিম সমাজে বইটি ব্যপকভাবে নিন্দিত হয়েছে।

5. হিজরতকারীদের মক্কা প্রত্যাবর্তন

ইতিহাসবিদদের মতে, হাবশায় হিজরতকারী সাহাবীরা এক সময় মক্কায় ফিরে আসেন কারণ শুনা যায় কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু পরে দেখা যায়, এটি ছিল গুজব। এই ভুল বোঝাবুঝির কারণ হিসেবেই শয়তানিক আয়াতের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিছু গ্রন্থে।

6. মুসলিম-মুশরিক সমবেত সিজদা

সূরা আন-নাজমের শেষ অংশে সিজদার আয়াত পাঠ করার পর বলা হয়, মক্কার কাফিররাও সিজদা করে। কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল মুহাম্মদের বক্তব্যে শয়তানের সংযোজন থাকার কারণে; যদিও অন্য মত বলে এটি ছিল মুহাম্মদের অলৌকিক প্রভাবের ফল।

7. ঘটনার সারসংক্ষেপ

ঘটনাটি মূলত এমন—মুহাম্মদ মক্কার তিন দেবী (লাত, উজ্জা, মানাত) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কিছু আয়াত পাঠ করেন। পরে জিবরাইল জানান, এটি শয়তানের অনুপ্রবেশ। মুহাম্মদ তা প্রত্যাহার করেন এবং সেসব আয়াত বাতিল ঘোষণা করেন।

8. সিরাতে রাসুলুল্লাহ – ইবনে ইসহাক

ইবনে ইসহাকের “সিরাতে রাসুলুল্লাহ”-তে এই ঘটনা উল্লেখ আছে, যদিও তার বর্ণনাটি ইবনে হিশাম ছেঁটে ফেলেন। ইবনে ইসহাক মুহাম্মদের জীবনী লেখকদের মধ্যে প্রাচীনতমদের একজন, এবং তার লেখার মাধ্যমেই এই ঘটনার প্রাচীনতম রেফারেন্স মেলে।

9. তাবাকাত আল কাবীর – ইবনে সাদ

ইবনে সাদের “তাবাকাত আল কাবীর” গ্রন্থেও শয়তানিক আয়াতের ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। তবে এতে বিস্তারিতভাবে মুহাম্মদের বক্তব্য এবং পরবর্তী জিবরাইলের সতর্কবাণীও আছে।

10. আল তাবারীর ইতিহাস থেকে

আল তাবারীর “তারিখ উর-রসুল ওয়াল মুলুক”-এ এই ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বহু সূত্র থেকে এই ঘটনা উপস্থাপন করেন, যদিও তাবারী নিজে কখনো বলেননি যে ঘটনাটি শতভাগ নির্ভরযোগ্য।

11. কোরআনের আয়াত ও তাফসীর

সূরা হজ্জ, আয়াত ৫২ হল মূল উৎস যেখান থেকে “শয়তানিক আয়াত” প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করা হয়। এখানে বলা হয়েছে, নবীর বক্তব্যে শয়তান হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলেও আল্লাহ তা বাতিল করেন।

11.1 তাফসীরে জালালাইন থেকে

জালালাইন তাফসীরে বলা হয়েছে, শয়তান মুহাম্মদের জবান থেকে কিছু বলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আল্লাহ তা মুছে দেন এবং সত্য স্থান দেয়।

11.2 তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে

ইবনে কাসীর এই ঘটনার বর্ণনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বলেন এটি দুর্বল বর্ণনা। তার মতে, এটি শিয়া বা মুনাফিকদের তৈরি করা গল্পও হতে পারে।

11.3 তাফসীরে মাজহারী থেকে

মাজহারী তাফসীরে বলা হয়েছে, ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য নয়; বরং শয়তানের অনুপ্রবেশের অর্থ এখানে কুমন্ত্রণা বোঝানো হয়েছে, আয়াত বলিয়ে দেয়া নয়।

12. বিষয়টি নিয়ে লুকোছাপা

ইসলামী বিশ্বে বহু আলেম, বিশেষ করে আধুনিক যুগে, এই ঘটনাটিকে “জাল” বা “মিথ্যা” বলে বাতিল করে দিয়েছেন। অনেক ইসলামি বইতে এই প্রসঙ্গ বাদ দেয়া হয়েছে, অথবা গোপন রাখা হয়েছে যাতে মুসলমানদের বিশ্বাসে চিড় না ধরে।

13. ধ্রুপদী আলেমদের বক্তব্য

ধ্রুপদী আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন ইমাম নববী ও ইবনে হাজার আসকালানি এই ঘটনাটিকে স্বীকার করেছেন, আবার অনেকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। আলেমদের মাঝে এই বিষয়ে একমত নেই।

14. ঘণ্টা – শয়তানের বাঁশি

কিছু হাদিসে মুহাম্মদ বলেছেন, তিনি যখন ওহী পান তখন তাঁর কানে ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এই ধ্বনি কি শয়তানের প্ররোচনা হতে পারে? তবে অধিকাংশ আলেম বলেন, এটি ছিল এক ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা।

15. উপসংহার

“শয়তানিক আয়াত” একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে জটিল ও বিতর্কিত ঘটনা। হারুন রুশদি এটি নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন যা অনেক মুসলমানের কাছে ধর্ম অবমাননার শামিল। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মুক্তচিন্তা, ইতিহাসের সত্যতা ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে একটি আলোচনার ক্ষেত্রও তৈরি করেছে। আমাদের উচিত তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করে ইতিহাসকে বুঝা এবং গোপন না রেখে খোলাখুলি আলোচনা করা।

Post a Comment

Previous Post Next Post