নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়: জ্ঞানের জ্যোতি থেকে বক্তিয়ার খিলজির আগুন পর্যন্ত
ভূমিকা
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো শুধু একটি দেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানচর্চাকে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তেমনই এক প্রতিষ্ঠান। আধুনিক অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা হার্ভার্ডের বহু শতাব্দী আগে, ভারতবর্ষে নালন্দা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে একসাথে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণায় নিমগ্ন থাকত। এটি কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্রই ছিল না, বরং ছিল একটি সম্পূর্ণ নগররাষ্ট্রের মতো—যেখানে দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সাহিত্য ও শিল্পকলার বিস্তৃত চর্চা হত।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব ছিল এর সর্বজনীনতা। এখানে বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি হিন্দু দর্শন, সাময়িক জ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, এমনকি বিদেশি চিন্তাধারাও পড়ানো হতো। ফলে এটি ভারতীয় উপমহাদেশকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। চীন, কোরিয়া, তিব্বত, জাপান, শ্রীলঙ্কা এমনকি মধ্য এশিয়া থেকেও জ্ঞানপিপাসুরা এখানে আসত শিক্ষালাভের জন্য।
তবে দুঃখজনক হলো—যে নালন্দা একসময় মানব সভ্যতার আলোকস্তম্ভ ছিল, সেটি ধ্বংস হয়ে গেছে এক হিংস্র বর্বর মুসলিম সেনাপতি বক্তিয়ার খিলজির হাতে। তার হাতে শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জ্ঞান, সংস্কৃতি ও মানবতার বিপুল ভাণ্ডার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আজ আমরা যদি নালন্দার সমস্ত তথ্য না-ও পাই, তার প্রধান কারণ এই বর্বরোচিত ধ্বংসযজ্ঞ।
এই ব্লগে আমরা দেখব—নালন্দার সূচনা থেকে উত্থান, বিকাশ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি, জ্ঞানের বিস্তার, এবং অবশেষে বক্তিয়ার খিলজির হাতে তার নির্মম পরিণতি। আর শেষে সেই পিশাচ বক্তিয়ার জন্য থাকবে যথাযোগ্য গালি ও ঘৃণা।
১. নালন্দার সূচনা ও প্রতিষ্ঠা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শুরু হয় খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে। গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রথম (৪১৩–৪৫৫ খ্রিঃ) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। যদিও বৌদ্ধধর্মের প্রসার এর বহু আগে থেকেই চলছিল, কিন্তু নালন্দা সেই জ্ঞানচর্চাকে একটি স্থায়ী রূপ দেয়। ইতিহাসবিদদের মতে, “নালন্দা” শব্দটি এসেছে “না-আলম-দা” থেকে, যার অর্থ “অসীম দান।” আবার কেউ কেউ বলেন, এটি এসেছে “নাল” (পদ্ম) ও “আন্দ” (অসংখ্য) থেকে—অর্থাৎ পদ্মফুলের আধার। যেকোনো অর্থেই বোঝা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার।
প্রথমদিকে এটি ছিল একটি মঠ ও শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে ভিক্ষুরা বৌদ্ধ ধর্মশিক্ষা ও দর্শনচর্চা করতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ভিক্ষুদের জ্ঞানচর্চা ও সমাজের আগ্রহ মিলিয়ে এটি ক্রমে এক বিশাল শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। শুধু ভারতের ভেতরে নয়, গোটা এশিয়াজুড়ে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় ভারতবর্ষকে বলা হতো “সোনার যুগ”, কারণ এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সেই স্বর্ণযুগেরই ফল। পরবর্তী শাসকরা—হর্ষবর্ধন (৬০৬–৬৪৭ খ্রিঃ), পাল সম্রাট ধর্মপাল (৭৭০–৮১০ খ্রিঃ) এবং অন্যান্য রাজারা—নালন্দার প্রসার ও উন্নতিতে বিরাট ভূমিকা রাখেন।
শুরু থেকেই নালন্দা ছিল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ছাত্র ও শিক্ষকরা স্থায়ীভাবে থাকতেন, যা সে সময়ের অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে এটি এক বিশাল নগর-আকৃতির জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়, যেখানে শুধু ধর্ম নয়, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শনসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের সমন্বিত শিক্ষা দেয়া হত।
নালন্দার প্রাচীনত্ব ও মর্যাদার কথা চিন্তা করলে এটিকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের “প্রোটোটাইপ” বলা যায়। আজকের দিনে আমরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনা করি—গ্রন্থাগার, আবাসন, গবেষণা, আন্তর্জাতিক ছাত্র বিনিময়—এসব সবকিছুর শিকড় লুকিয়ে আছে নালন্দার মধ্যে।
২. গৌতম বুদ্ধের প্রভাব ও বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে উত্থান
নালন্দার উত্থানকে বোঝার জন্য গৌতম বুদ্ধের প্রভাবকে আলাদা করে দেখা জরুরি। যদিও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ঘটে বুদ্ধের প্রায় ৮০০ বছর পরে, তবুও এর আদর্শ ও শিক্ষাদর্শন মূলত বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে।
বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জ্ঞানচর্চা, যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, ধ্যান ও মুক্তির পথকে ব্যাখ্যা করা। গৌতম বুদ্ধ নিজে বহুবার নালন্দার আশপাশে অবস্থান করেছেন। প্রাচীন সূত্র অনুযায়ী, তিনি প্রায় ৭৫ বার নালন্দায় এসেছিলেন। এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ, নদী, বাগান ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধ্যান ও জ্ঞানচর্চার জন্য আদর্শ ছিল। ফলে বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই নালন্দা অঞ্চলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভিত্তি তৈরি হয়।
এরপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট বিহার স্থাপন করতে শুরু করেন। সেসব বিহার থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটি বৃহৎ শিক্ষাকেন্দ্র। ফলে নালন্দা ছিল বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বের শিক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় মঞ্চ। এখানে পালি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাতেও শিক্ষা চলত।
চীন থেকে আসা ভিক্ষু হিউয়েন সাং (Xuanzang) এবং ঈ-চিং (Yijing) তাঁদের ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন, নালন্দায় বৌদ্ধ দর্শনের বিভিন্ন শাখা যেমন মহাযান, হীনযান ও বজ্রযান সমানভাবে পড়ানো হতো। এর পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বেদান্ত ইত্যাদিও পড়ানো হতো। ফলে নালন্দা শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং এটি ছিল মুক্ত চিন্তার আদর্শ স্থান, যেখানে মতবাদের ভিন্নতা নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার সুযোগ ছিল।
গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা “যুক্তি ও করুণার মিশেল” নালন্দাকে আন্তর্জাতিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে শিখতে চাইত কীভাবে জ্ঞান ও নৈতিকতার সমন্বয়ে মানবজীবনকে উন্নত করা যায়।
ফলাফল হলো, নালন্দা বৌদ্ধ বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। একদিকে এটি বৌদ্ধ ধর্মের আলো ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে এটি এক ধরনের বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মর্যাদা পাচ্ছিল—যেখানে জ্ঞানের কোনো সীমানা ছিল না।
৩. রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমৃদ্ধি
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন যুগের রাজাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা। শুধুমাত্র ভিক্ষু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারত না। রাজারা একে তাদের গৌরবের অংশ মনে করতেন এবং বিপুল অর্থ, জমি, স্থাপত্যকলা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতেন।
কুমারগুপ্ত প্রথম (৪১৩–৪৫৫ খ্রিঃ) – নালন্দার ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী শাসক। কুমারগুপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেছিলেন এবং এর স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
হর্ষবর্ধন (৬০৬–৬৪৭ খ্রিঃ) – এই সম্রাট নালন্দাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেন এবং বহু ভবন নির্মাণ করান। হর্ষবর্ধনের শাসনামলেই নালন্দা বিদেশি ছাত্রদের কাছে পরিচিত হয়। চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাং তাঁর আমলেই নালন্দায় পড়াশোনা করেন।
পাল সাম্রাজ্য (৮ম–১২শ শতক) – নালন্দার স্বর্ণযুগ আসে পাল রাজাদের হাতে। বিশেষ করে ধর্মপাল (৭৭০–৮১০ খ্রিঃ) এবং দেবপাল (৮১০–৮৫০ খ্রিঃ) নালন্দাকে একটি মহীরুহে পরিণত করেন। ধর্মপাল ১০৮টি মঠ, অসংখ্য মন্দির ও ছাত্রাবাস নির্মাণ করান। দেবপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার আরও বিস্তৃত করেন এবং বিদেশি ভিক্ষুদের থাকার জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা করেন।
পাল যুগে নালন্দায় ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার এবং শিক্ষক ছিলেন প্রায় ২ হাজার। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকার এত বড় হয়ে যায় যে এটি প্রায় একটি নগরের সমান হয়ে দাঁড়ায়।
রাজারা শুধু ভবন নির্মাণই করেননি, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের জন্য জমিদান করেছিলেন। বলা হয়, নালন্দার খরচ চলত প্রায় ২০০টি গ্রামের আয়ে। এসব গ্রাম থেকে আসা ধান, শস্য, তেল, ঘি, কাপড়, এমনকি শ্রমিকও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে লাগত। ফলে নালন্দা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ইউনিটে পরিণত হয়।
রাজাদের এই ধারাবাহিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই নালন্দা টিকে ছিল প্রায় ৭০০ বছর। এশিয়ার ইতিহাসে এত দীর্ঘকাল ধরে একটানা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নজির খুব কমই আছে।
রাজারা নালন্দাকে কেবল ধর্মীয় কারণে সমর্থন দেননি, বরং তাঁরা বুঝতেন যে জ্ঞানচর্চা তাদের রাজ্যকে সমৃদ্ধ করে। ফলে নালন্দার সমৃদ্ধি আসলে রাজাদের সমৃদ্ধিরই প্রতিফলন ছিল।
৪. শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল প্রাণ ছিল এর শিক্ষক ও ছাত্ররা। এরা শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাজগতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। নালন্দার খ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এখানে ভর্তি হওয়াই ছিল এক ধরনের গৌরবের বিষয়।
শিক্ষক সমাজ
নালন্দার শিক্ষকরা ছিলেন কেবল ধর্মীয় গুরু নন, তাঁরা ছিলেন বিশ্বমানের পণ্ডিত, গবেষক ও দার্শনিক। তাঁদের মধ্যে অনেকের নাম আজও ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
- ধর্মপাল ও শান্তরক্ষিত ছিলেন বৌদ্ধ দর্শনের প্রসিদ্ধ গুরু।
- সিলভদ্র (Silabhadra) ছিলেন নালন্দার আচার্য, যার কাছে চীনের হিউয়েন সাং পড়াশোনা করেছিলেন। সিলভদ্র যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও ধ্যানচর্চায় অদ্বিতীয় ছিলেন।
- ধর্মকীর্তি, যিনি ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, তিনি নালন্দারই অধ্যাপক ছিলেন।
চিকিৎসা শাস্ত্রে জাতকর্মনন্দন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে আর্যভট্টের শিষ্যরা এখানে পাঠদান করতেন।
শিক্ষকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২,০০০। তাঁরা প্রত্যেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন এবং ছাত্রদের শুধু শিক্ষা নয়, গবেষণায়ও অনুপ্রাণিত করতেন।
ছাত্র সমাজ
নালন্দায় ছাত্রসংখ্যা ছিল আনুমানিক ১০,০০০। এর মধ্যে অনেকেই বিদেশ থেকে এসেছিল। চীন, কোরিয়া, তিব্বত, জাপান, শ্রীলঙ্কা, মঙ্গোলিয়া এবং মধ্য এশিয়ার বহু দেশ থেকে ছাত্ররা আসত। ভর্তি হতে হলে কঠিন পরীক্ষা দিতে হতো। অনুমান করা হয়, শতকরা মাত্র ২০–৩০ শতাংশ ছাত্রই ভর্তি হতে পারত।
ছাত্রদের জীবন ছিল নিয়মিত ও কঠোর। সকালে ধ্যান, এরপর পাঠ, বিকেলে আলোচনা, এবং রাতে গ্রন্থাগারে অধ্যয়ন—এটাই ছিল তাঁদের রুটিন। ছাত্ররা শুধু ধর্মতত্ত্ব নয়, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি পড়ত।
আবাসিক ব্যবস্থা ছিল অসাধারণ। ছাত্রদের জন্য আলাদা কক্ষ, খাবারের ব্যবস্থা, এমনকি পানীয় জল ও স্নানের জন্যও পর্যাপ্ত সুবিধা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ছিল বিশাল প্রাচীর, যা একে সুরক্ষিত রাখত।
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক
নালন্দার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল শিক্ষক ও ছাত্রের আন্তরিক সম্পর্ক। এখানে শুধু পাঠদানই হত না, বরং প্রশ্নোত্তর, বিতর্ক, ও গবেষণার পরিবেশ ছিল। ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করত। ফলে শিক্ষা ছিল প্রাণবন্ত, যুক্তিনির্ভর ও মুক্তমনা।
চীনা ভিক্ষু হিউয়েন সাং লিখেছেন, “নালন্দার শিক্ষকরা এতই উচ্চমানের ছিলেন যে তাদের একটি প্রশ্নোত্তর সেশনই ছাত্রদের বহুদিনের সংশয় দূর করে দিত।”
সংক্ষেপে বলা যায়, শিক্ষক ও ছাত্রসমাজই নালন্দাকে প্রাণবন্ত রেখেছিল। তারা একে শুধু একটি শিক্ষাকেন্দ্র নয়, বরং একটি জীবন্ত জ্ঞাননগরীতে রূপান্তরিত করেছিল।
৫. আন্তর্জাতিক খ্যাতি (চীন, কোরিয়া, তিব্বত, জাপান পর্যন্ত প্রভাব)
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র এশিয়ায় জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত ছিল। এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এমনভাবে যে দূর-দূরান্তের ভিক্ষু, ছাত্র ও পণ্ডিতরা হাজার মাইল ভ্রমণ করে এখানে আসতেন। এটি আসলে প্রাচীন যুগের “আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়” বলা চলে।
চীন
চীন থেকে বহু ভিক্ষু নালন্দায় এসেছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন হিউয়েন সাং (Xuanzang) এবং ঈ-চিং (Yijing)।
-
হিউয়েন সাং ৭ম শতকে নালন্দায় প্রায় ১৭ বছর অবস্থান করেন। তিনি এখানে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও সংস্কৃত শিখেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি “Great Tang Records on the Western Regions” আজও নালন্দার ইতিহাসের প্রধান উৎস।
-
ঈ-চিং নালন্দায় পড়াশোনা করে চীনে ফিরে গিয়ে বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, “নালন্দার শিক্ষক ও ছাত্রদের জীবন এতটাই নিয়মতান্ত্রিক যে মনে হয় জ্ঞানচর্চাই তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস।”
কোরিয়া
কোরিয়ার ভিক্ষুরাও নালন্দায় এসেছিলেন। তারা এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের প্রসার ঘটান। নালন্দার মাধ্যমে কোরিয়ায় শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, ভাষাতত্ত্ব ও যুক্তিবিদ্যাও পৌঁছে যায়।
তিব্বত
তিব্বতের সঙ্গে নালন্দার সম্পর্ক ছিল গভীর। তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের মূলভিত্তি এসেছে নালন্দা থেকেই। নালন্দার ভিক্ষুরা তিব্বতে গিয়ে শিক্ষা দিতেন, আবার তিব্বতের ছাত্ররা নালন্দায় এসে পড়াশোনা করতেন। আজও তিব্বতের অনেক মঠে “নালন্দা ট্র্যাডিশন” নামে একটি শিক্ষাপদ্ধতি চালু আছে। দালাই লামা নিজেও প্রায়ই বলেন, তিব্বতের ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্য নালন্দারই উত্তরাধিকার।
জাপান
জাপানেও নালন্দার প্রভাব পৌঁছেছিল। বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে দর্শন ও নৈতিক শিক্ষা জাপানে প্রবেশ করে নালন্দার ভিক্ষুদের মাধ্যমে। যদিও দূরত্ব অনেক বেশি ছিল, তবুও নালন্দার আলো জাপান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
শ্রীলঙ্কা, বার্মা (মিয়ানমার), থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশেও নালন্দার প্রভাব পড়েছিল। এখানকার ছাত্ররা নালন্দায় পড়াশোনা করে নিজেদের দেশে ফিরে বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞানচর্চা বিস্তার করতেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
হিউয়েন সাং লিখেছেন, “নালন্দার খ্যাতি এতটাই যে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ এখানে আসতে চাইত।” নালন্দার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এটিকে একেবারে অনন্য করে তোলে। একে আজকের হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের সমকক্ষ মনে করা যায়।
নালন্দার মাধ্যমে ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল বিশ্বের জ্ঞানরাজধানী। এশিয়ার জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
৬. নালন্দার গ্রন্থাগার: ধর্মগঞ্জ (Dharma Ganj)
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও গৌরবময় অংশ ছিল এর বিশাল গ্রন্থাগার। একে বলা হতো “ধর্মগঞ্জ” (Dharma Ganj) বা “ধর্মের ভাণ্ডার”। এটি শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিত ছিল।
গ্রন্থাগারের কাঠামো
ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, নালন্দার গ্রন্থাগার ছিল তিনটি ভবন নিয়ে গঠিত। এগুলোর নাম ছিল—
-
Ratnasagara (রত্নসাগর) – জ্ঞানের সমুদ্র
-
Ratnadadhi (রত্নআধি) – জ্ঞানের আধার
-
Ratnaranjaka (রত্নরঞ্জক) – জ্ঞানের আলোকদাতা
এই ভবনগুলো ছিল বহু তলা বিশিষ্ট, বিশেষত Ratnasagara ছিল নয়তলা উঁচু। প্রতিটি ভবনে অসংখ্য কক্ষ ভরা থাকত পুঁথি, দলিল, ধর্মগ্রন্থ, চিকিৎসাবিদ্যার নথি, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থে।
সংগ্রহ
গ্রন্থাগারে কয়েক লক্ষ পুঁথি সংরক্ষিত ছিল।
-
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ—ত্রিপিটক, মহাযান সূত্র, বজ্রযান তন্ত্র।
-
হিন্দু দর্শন—বেদান্ত, উপনিষদ, সাংখ্য, যোগ, ন্যায়শাস্ত্র।
-
জ্যোতির্বিজ্ঞান—আর্যভট্ট ও বরাহমিহিরের রচনা।
-
চিকিৎসাশাস্ত্র—আয়ুর্বেদ, শল্যবিদ্যা, ভেষজ বিদ্যা।
-
সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব—সংস্কৃত ব্যাকরণ, নাট্যশাস্ত্র, কাব্যতত্ত্ব।
ঈ-চিং উল্লেখ করেছেন, নালন্দার গ্রন্থাগারে “এমন কোনো বিষয় নেই যা সেখানে পাওয়া যেত না।”
গবেষণার কেন্দ্র
গ্রন্থাগার শুধু বইয়ের ভাণ্ডারই ছিল না, বরং ছিল গবেষণার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষক-ছাত্ররা দিনরাত সেখানে বসে অধ্যয়ন করতেন। নতুন গ্রন্থ রচনা, পুরোনো গ্রন্থ অনুবাদ, এবং গবেষণা-নিবন্ধ তৈরি হতো এখানেই।
চীন, কোরিয়া, তিব্বত থেকে আসা ভিক্ষুরা নালন্দার গ্রন্থাগারে দীর্ঘদিন অবস্থান করে গ্রন্থ অনুবাদ করে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতেন। ফলে নালন্দার জ্ঞানের আলো সীমান্ত ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বহু দেশে।
এক অমূল্য ধনভাণ্ডার
কল্পনা করা যায়, আজ যদি সেই গ্রন্থাগার অক্ষত থাকত, তাহলে প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে আমাদের ধারণা কত সমৃদ্ধ হতো! বিজ্ঞানের অজানা বহু তথ্য, চিকিৎসাশাস্ত্রের নতুন দিক, দর্শনের অসংখ্য তত্ত্ব হয়তো আজ আমাদের হাতে থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বক্তিয়ার খিলজির আগুনে সেই অমূল্য ভাণ্ডার ভস্মীভূত হয়ে গেছে। বলা হয়, নালন্দার গ্রন্থাগার মাসের পর মাস ধরে জ্বলেছিল—এত বইয়ের স্তুপ ছিল সেখানে।
নালন্দার গ্রন্থাগার মানবসভ্যতার ইতিহাসে জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাণ্ডারগুলোর একটি ছিল। আজ আমরা যা হারিয়েছি, তা আর কোনোদিন পূর্ণ করা সম্ভব নয়।
৭. নালন্দার অবদান দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ও যুক্তিবিদ্যায়
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না; এটি ছিল বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চার অঙ্গন। এখানে যে ধরনের জ্ঞানচর্চা হতো, তা আজকের “বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয়” ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। নালন্দার অবদান এতই গভীর যে মানবসভ্যতার অনেক অগ্রগতির শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় এখানেই।
দর্শন
নালন্দা ছিল ভারতীয় দর্শনের প্রাণকেন্দ্র।
-
বৌদ্ধ দর্শনের মহাযান, হীনযান ও বজ্রযান শাখা সমান গুরুত্ব পেত।
-
হিন্দু দর্শনের সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, মীমাংসা ও বেদান্তও শেখানো হতো।
-
যুক্তিবিদ্যা ও বিতর্কচর্চা ছিল শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি। শিক্ষক-ছাত্ররা মুক্তভাবে বিতর্ক করতেন এবং সত্য অনুসন্ধান করতেন।
এখানকার দর্শনচর্চা শুধু ধর্মীয় সীমায় সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল বাস্তব জ্ঞানের অনুসন্ধান, যুক্তি ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল।
চিকিৎসা
নালন্দা আয়ুর্বেদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল।
-
ভেষজবিদ্যা, শল্যচিকিৎসা, রোগ নির্ণয় ও রোগ প্রতিরোধের কৌশল শেখানো হতো।
-
ছাত্ররা শুধু তত্ত্ব শিখত না, বরং ব্যবহারিক চিকিৎসাও শিখত।
-
ভেষজ উদ্ভিদের বাগান ছিল, যেখানে ওষুধ প্রস্তুত করা হতো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক জ্ঞান নালন্দা থেকে তিব্বত, চীন ও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল নালন্দার মাধ্যমে।
-
এখানে আর্যভট্ট-এর রচনা পড়ানো হতো।
-
পৃথিবী গোলাকার এবং এটি নিজের অক্ষে ঘুরছে—এমন ধারণা ছাত্ররা এখানেই শিখত।
-
সৌরগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ নির্ণয়ের কৌশল শেখানো হতো।
এই জ্ঞান পরবর্তী কালে আরব বিশ্বে পৌঁছে যায়, সেখান থেকে ইউরোপে গিয়ে নবজাগরণের (Renaissance) ভিত্তি তৈরি করে।
গণিত
নালন্দা গণিতের উন্নত শিক্ষা দিত।
-
শূন্য (০) এবং দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার এখান থেকেই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
-
বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতি পড়ানো হতো।
-
গণিত ব্যবহার হতো জ্যোতির্বিজ্ঞান, স্থাপত্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও।
যুক্তিবিদ্যা
নালন্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর যুক্তিনির্ভর শিক্ষা।
-
ধর্মকীর্তি ও দীননাগ-এর মতো মহাপণ্ডিতেরা এখানে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়াতেন।
-
ছাত্ররা তর্কশাস্ত্র শিখত, বিতর্ক করত, এবং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করত।
এই ধারা পরবর্তী কালে তিব্বত ও চীনের দর্শনচর্চায় গভীর প্রভাব ফেলে।
সমন্বিত শিক্ষা
নালন্দার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এটি ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও মানবিক বিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য ও শিল্পকলা শেখানো হতো। ফলে ছাত্ররা ছিল সর্বাঙ্গীন জ্ঞানসম্পন্ন।
আজকের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা—তার ভিত্তি আসলে নালন্দার মধ্যেই নিহিত ছিল।
. সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্রই ছিল না; এটি পুরো সমাজের, সংস্কৃতির এবং অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এর উপস্থিতি একটি অঞ্চলের মানসিকতা, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তন করেছিল।
সমাজের ওপর প্রভাব
নালন্দা সমাজে শিক্ষার মর্যাদা উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠতর মূল্য হিসেবে দেখত। শিক্ষক ও ভিক্ষুরা সমাজে মান্যতা পেতেন। ছাত্ররা, যারা দূর-দূরান্ত থেকে আসত, স্থানীয় জনগণকে বিভিন্ন জ্ঞান ও কৌশল শিখাত।
-
শিশু ও যুবকদের মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ জন্মায়।
-
সমাজে বিতর্ক ও যুক্তি-ভিত্তিক চিন্তাধারার প্রচলন হয়।
-
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে জ্ঞানচর্চায় অংশ নিত।
সংস্কৃতির ওপর প্রভাব
নালন্দা ছিল শিল্প ও সংস্কৃতিরও কেন্দ্র। এখানে নাট্যশাস্ত্র, কাব্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য ও সঙ্গীত চর্চা হত।
-
ছাত্ররা নিজেদের দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করত।
-
বিদেশি ছাত্রদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের শিল্প ও সাহিত্য নালন্দায় মিলিত হত।
-
সংস্কৃতির এই মিলন আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব ও আদান-প্রদানের উৎস হত।
অর্থনীতির ওপর প্রভাব
নালন্দার উপস্থিতি অঞ্চলের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছিল।
-
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাহিদা সৃষ্টি হতো—খাবার, পোশাক, আবাসন, যানবাহন ইত্যাদিতে।
-
বহু শ্রমিক ও কারিগর এখানে নিয়মিত কাজ করত।
-
স্থানীয় বাজার ও কৃষি ব্যবসায় সমৃদ্ধি আসে।
-
বিদেশি ছাত্রদের আগমন স্থানীয় বাণিজ্য ও হোটেল ব্যবসায়ও সাহায্য করত।
আন্তর্জাতিক সংযোগ
নালন্দার মাধ্যমে ভারতবর্ষ বিশ্বের সঙ্গে শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত হয়। চীনা, কোরিয়ান, তিব্বতীয় ও জাপানি ছাত্ররা নালন্দায় আসত। তারা ফিরে নিজেদের দেশে শিক্ষার ছোঁয়া ছড়াত। ফলে নালন্দা কেবল স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সভ্যতার উন্নতিতে অবদান রাখত।
সংক্ষেপে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এমন এক কেন্দ্র ছিল যা মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক প্রবাহকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করেছিল। এটি ছিল শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র।
৯. পতনের শুরু ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ শতাব্দী ধরে জ্ঞান, গবেষণা এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। কিন্তু ইতিহাসে সব মহান প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংসের আঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। নালন্দার পতনের প্রাথমিক কারণ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
৮ম থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর নালন্দা ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। ছোট ছোট রাজ্য, জঙ্গী শাসক এবং সামরিক কেলেঙ্কারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল।
-
নিয়মিত যুদ্ধ ও লুটপাট নালন্দার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছিল।
-
রাজা এবং স্থানীয় অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতা কমে যায়।
-
অর্থায়ন দুর্বল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রভাবিত হতে থাকে।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
নালন্দার শাসন ও প্রশাসনও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
-
গ্রন্থাগার ও শিক্ষামূলক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত নজর ছিল না।
-
শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যা কমে যায়।
-
বিদেশি ছাত্রদের আগমন কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক সংযোগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ধর্মীয় উত্তেজনা
নালন্দা মূলত বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র হলেও এখানে হিন্দু দর্শন ও অন্যান্য বিদ্যাও শেখানো হতো। সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় উত্কণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। বৌদ্ধ শিক্ষাকে হুমকি হিসেবে দেখা শুরু হয়। বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় ইসলামি সেনাপতিদের আগমন নালন্দার জন্য ধ্বংসযজ্ঞের প্রাক্কালে এক নতুন বিপদ।
পতনের লক্ষণ
-
গ্রন্থাগার এবং আবাসিক ভবনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ হ্রাস পায়।
-
শিক্ষক ও পণ্ডিতেরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে।
-
ছাত্র সংখ্যা কমে যায়, গবেষণার গুণগত মান হ্রাস পায়।
এই সব কারণ মিলে নালন্দার ধ্বংসের পথ প্রস্তুত করে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় তার পূর্ণ সমৃদ্ধি হারাচ্ছিল, আর একটি মাত্র আঘাত—যেটি আসে বক্তিয়ার খিলজির হাতে—সেই নালন্দাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়।
১০. বক্তিয়ার খিলজির আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম পতন ঘটে ১২শ শতকের বক্তিয়ার খিলজির হাতে। ইতিহাস অনুযায়ী, খিলজি হঠাৎ আক্রমণ চালায় এবং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসযজ্ঞ মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক অমূল্য ক্ষতি।
আক্রমণের কারণ
খিলজির আগমন মূলত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উভয়ই।
-
তিনি ভারতীয় অঞ্চলকে শাসনের আওতায় আনার প্রয়াসে নালন্দার মতো সমৃদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রকে হুমকি হিসেবে দেখেন।
-
বৌদ্ধ শিক্ষার আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা তাকে পছন্দের ছিল না।
-
সম্ভবত তিনি মনে করতেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় লোভনীয় সম্পদ এবং অর্থের উৎস।
ধ্বংসযজ্ঞ
খিলজির সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘেরাও করে।
-
প্রথমে তারা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও ভিক্ষুদের উপর আক্রমণ চালায়।
-
তারপর ধ্বংস করা হয় আবাসিক ভবন, মঠ, মন্দির এবং গ্রন্থাগার।
-
বিশেষত ধর্মগজ্ঞ—বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগার—মাসের পর মাস ধরে আগুনে ভস্মীভূত হয়।
ক্ষতি ও মানবতার প্রভাব
-
১০০,০০০-এর বেশি পাণ্ডিত ও ছাত্রের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
অমূল্য গ্রন্থ ও গবেষণা চিরতরে হারিয়ে যায়।
-
আন্তর্জাতিক ছাত্র ও ভিক্ষুরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
-
বৌদ্ধ শিক্ষা ও দর্শনের বিস্তার প্রায় থেমে যায়।
চরম নির্দয়তা
খিলজি শুধুমাত্র ভবন ধ্বংস করেনি, তিনি মানবতাকে আঘাত করেছেন। ইতিহাসে বলা হয়, তিনি ছাত্রদের জড়িয়ে ধরত এবং জীবন্তভাবে জ্বালাত, গ্রন্থগুলো ছিন্নভিন্ন করে নদীতে নিক্ষেপ করত। এমন নিষ্ঠুরতা দেখার পর বিশ্ববাসী শোকাহত হয়।
সর্বশেষ, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। যা একটি আন্তর্জাতিক জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে পারত, সেটি আজ শুধু ইতিহাসের পাতায় স্মৃতিরূপে রয়ে গেছে।
এবং হ্যাঁ, এই বর্বর বক্তিয়ার খিলজি, যার কারণে এতো অমূল্য জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং মানবতার ইতিহাস ধ্বংস হয়, তার জন্য বলতে হয়:
“বক্তিয়ার খিলজি, তুই ছিলি এক নির্মম পিশাচ, এক ঘৃণ্য বর্বর, যার বোকামি ও নিষ্ঠুরতা হাজার বছরের জ্ঞানকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। তোর মতো শয়তান আবার কখনো জন্মায় না পৃথিবীতে। তুই ইতিহাসের সবচেয়ে নরকীয় বর্বরদের মধ্যে একজন।”
১১. খিলজিকে অভিশাপ ও সমাপ্তি
বক্তিয়ার খিলজির ধ্বংসযজ্ঞ ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। তার হাত ধরেই নালন্দার কোটি কোটি অমূল্য জ্ঞান, গ্রন্থ, গবেষণা এবং মানবতার আলোকিত অংশ চিরতরে হারিয়ে যায়। এই বর্বরকে ইতিহাস কখনও ভুলবে না।
খিলজির বর্বরতা
-
সে শুধু ভবন ধ্বংস করেনি, বরং মানুষকে নির্যাতন করেছেন।
-
পণ্ডিত ও ছাত্রদের হত্যা, গ্রন্থাগার আগুনে পুড়িয়ে ফেলা, সংস্কৃতি ধ্বংস—সবই তার নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক।
-
এ ধরনের হিংসা ও নিষ্ঠুরতা ইতিহাসে বিরল।
অভিশাপ
যে লোক ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় শিক্ষা কেন্দ্রকে ধ্বংস করেছে, তাকে শুধুমাত্র দণ্ড নয়, বরং মানবতার অভিশাপই পাওয়া উচিত। ইতিহাস চিরকাল তাকে এক বর্বর, নিষ্ঠুর ও অজ্ঞ পিশাচ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
-
তোর ঘৃণ্যতা, বোকামি ও নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর প্রতি শাপ হয়ে থাকবে।
-
তোর কারণেই ভারতবর্ষ ও সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানচর্চা বহু শতাব্দীর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
-
তুই ইতিহাসে চিরকাল নিন্দিত ও ঘৃণ্যতম ব্যক্তি হিসেবে নাম কতোবার লেখা হয়েছে, সেটা সব সময় মানুষ মনে রাখবে।
সমাপ্তি
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মানবতার জ্ঞানকেন্দ্র, যা শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সমাজের উন্নয়নের মডেল হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বক্তিয়ার খিলজির মতো বর্বরদের কারণে সেই জ্ঞানভান্ডার আজ ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ।
এটি আমাদের শিখায় যে, অজ্ঞতা ও নির্মমতা ইতিহাসকে কতটা ধ্বংস করতে পারে। তাই নালন্দার স্মৃতি আমাদের জন্য চিরকাল শিক্ষার এবং সতর্কতার প্রতীক।
বক্তিয়ার খিলজি, তুই চিরকাল একটি নামমাত্র অভিশাপ হিসেবেই ইতিহাসে থাকবে—যে নাম শুনলেই জ্ঞান, মানবতা ও সভ্যতার অগ্নিকুণ্ডের কথা মনে হবে।
কোন মন্তব্য নেই: