১. মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এবং কৌতূহল থেকেই ধর্মের সূচনা
প্রাক-মানব প্রাণীদের (যেমন হোমো ইরেক্টাস বা নিয়ান্ডারথাল) মাঝে যুক্তির সক্ষমতা ও ভাষার বিকাশ ঘটার আগেই তারা প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা বা ভয় অনুভব করতো। যখন মানুষ আগুন, বজ্রপাত, সূর্যোদয়, চাঁদের আবর্তন, জন্ম-মৃত্যু, স্বপ্ন ইত্যাদির ব্যাখ্যা দিতে পারতো না, তখন এসব ঘটনাকে তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির কাজ বলে মনে করতো।
*ভয়ের ভূমিকা: বজ্রপাত, ঝড়, ভূমিকম্প – এসব মানুষকে আতঙ্কিত করতো। তারা ভাবতো, হয়তো কোনো রাগান্বিত আত্মা বা শক্তি এগুলো ঘটাচ্ছে।
*প্রশ্নের জন্ম: কেন কেউ মারা যায়? স্বপ্নে মৃত মানুষ দেখা যায় কেন? রোগ কেন হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে মানুষ ভাবতে শুরু করলো, নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য জগৎ আছে।
* প্রথম ধারণা: এই অদৃশ্য জগতের বাসিন্দাদের তুষ্ট রাখলেই বুঝি বিপদ এড়ানো যায়। এভাবেই আত্মা, দেবতা, টোটেম বা রক্ষাকর্তার ধারণা তৈরি হতে থাকে।
এই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল এবং ভয়-প্রসূত ব্যাখ্যাই ছিল ধর্মের আদিম বীজ।
২. ধর্মের জন্মে সমাজ ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা
যখন মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বসবাস করতে শুরু করলো (যেমন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ), তখন তাদের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি হয়ে উঠলো। কিন্তু লিখিত আইন বা বিচার ব্যবস্থা তখনো ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ধর্ম একটি কার্যকর সামাজিক নিয়ন্ত্রক পদ্ধতি হয়ে উঠলো।
* নৈতিকতা নির্ধারণের প্রয়াস: “চুরি করো না”, “মিথ্যা বলো না”, “পরের স্ত্রীকে স্পর্শ করো না”—এই ধরণের নীতির পেছনে যুক্তি বোঝানোর চাইতে বলা হতো, “ঈশ্বর রেগে যাবে” বা “আত্মারা অভিশাপ দেবে”। এর ফলে মানুষ নীতিনৈতিক আচরণে উৎসাহিত হতো।
* যাজকদের আবির্ভাব: সমাজে এক শ্রেণির মানুষ গড়ে উঠলো যারা দাবি করতো যে তারা দেবতাদের বার্তা শোনে বা জানে—এই শ্রেণি ছিল পুরোহিত, শামান বা যাজক। তারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করত এবং বলত—“দেবতা বলেছেন, এটা করো / ওটা কোরো না”।
* সমষ্টিগত আচার-অনুষ্ঠান: উৎসব, পূজা, বলিদান ইত্যাদি ধর্মীয় রীতিনীতি মানুষের মাঝে একতা আনতো, একটি সম্মিলিত ‘আমরা’ ধারণা তৈরি করতো।
৩. ধর্ম কীভাবে মৃত্যু ও অমরতার ভয় থেকে জন্ম নেয়
মৃত্যু সব সময়ই মানুষের জন্য সবচেয়ে গভীর ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন ছিল। যখন প্রিয়জন হঠাৎ মারা যায়, তখন তাদের নিথর শরীর দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে—কোথায় গেলো সে? কী হলো তার অস্তিত্বের?
এই প্রশ্নগুলো থেকেই জন্ম নেয় আত্মা, পুনর্জন্ম, স্বর্গ-নরক, পরকাল ইত্যাদি ধারণা।
* মৃত্যুভয়: কেউ যখন দেখে তার সন্তান বা মা হঠাৎ মারা গেছে, তখন সে মেনে নিতে পারে না যে “এটাই শেষ”। মানুষ চায় প্রিয়জনকে আবার ফিরে পেতে, তাই বিশ্বাস গড়ে ওঠে—তারা কোথাও আছে।
* আত্মার ধারণা: প্রাচীন মানুষ বিশ্বাস করতো, শরীর মারা গেলেও ভেতরের "প্রাণ" বা "আত্মা" বেঁচে থাকে। এই আত্মা হয়তো আরেক দেহে জন্ম নেয় বা অন্য জগতে যায়।
* পরকাল বিশ্বাস: অনেক ধর্মে দেখা যায় স্বর্গ ও নরকের ধারণা এসেছে—যেখানে ভালো কাজের পুরস্কার বা খারাপ কাজের শাস্তি দেওয়া হয়। এই ধারণাগুলো সমাজের মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করত।
* বলিদান ও শ্রাদ্ধ: অনেক সংস্কৃতিতে মৃত আত্মাকে তুষ্ট করার জন্য খাবার দেওয়া হয়, বলিদান দেওয়া হয়, যাতে সে শান্তিতে থাকতে পারে এবং জীবিতদের ক্ষতি না করে।
এইভাবে, মৃত্যুর অজানা ভয় এবং প্রিয়জনকে ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ধর্মীয় ধারণাগুলোর জন্ম হয়েছিল।
৪. প্রকৃতির শক্তিকে ঈশ্বর রূপে কল্পনা করা
প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির অসাধারণ ও ভয়ঙ্কর শক্তিগুলোকে ব্যাখ্যা করতে না পেরে সেগুলোকেই একেকজন ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত সত্তা হিসেবে কল্পনা করেছিল। এই রূপক কল্পনার মধ্য দিয়েই পলিথেইস্টিক (বহু-ঈশ্বরবাদী) ধর্মগুলোর জন্ম হয়।
* সূর্য ও চাঁদ: সূর্য দিনের আলো দেয়, গাছপালা জন্মায়, শীতের পর গরমে জীবন ফিরে আসে—এই বিশাল প্রভাব দেখে মানুষ সূর্যকে দেবতা ভাবতে শুরু করে। একইভাবে, চাঁদের গতিবিধি, পূর্ণিমা-অমাবস্যা মানুষের মনে বিস্ময় জাগাতো।
* বৃষ্টি ও বজ্রপাত: বৃষ্টির উপর নির্ভর করে ফসল জন্মাতো। তাই বৃষ্টিকে “আশীর্বাদ” এবং খরাকে “অভিশাপ” ভাবা হতো। এভাবেই বৃষ্টির দেবতা, বজ্রের দেবতা জন্ম নেয়।
* নদী ও সাগর: নদী জীবন দেয়, পানি আনে—তাকে মা হিসেবে কল্পনা করা হয় (যেমন: গঙ্গা, নাইল)। আবার সাগরের ভয়ঙ্করতা দেখে সেখানে এক ধরণের “সামুদ্রিক দেবতা” কল্পিত হয়।
* আগুন ও বাতাস: আগুন ছিল একাধারে রন্ধন ও আলোয়ের উৎস, আবার ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী। বাতাস ছিল অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী—এগুলোও আলাদা দেবতা হিসেবে স্থান পায়।
এইভাবে, প্রকৃতির প্রতিটি শক্তিকে ঈশ্বর হিসেবে কল্পনা করা হয়—কারণ মানুষ ভাবতো, যদি আমরা তাদের পূজা করি, তাহলে তারা আমাদের সহায় হবেন; আর না করলে বিপদ আনবেন।
৫. ধর্ম ও পুরাণের বিকাশ: গল্পের মাধ্যমে বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়া
ধর্ম শুধু নিয়ম বা উপাসনার মাধ্যম নয়—এটা বহু গল্প, পৌরাণিক কাহিনি ও চরিত্রের এক বিস্তৃত জগত। আদিম যুগে মানুষের শিক্ষার প্রধান পদ্ধতি ছিল গল্প বলা। এই কাহিনিগুলোর মাধ্যমেই ধর্মীয় ধারণাগুলো সহজভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে এবং গভীর বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে।
*গল্প মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে: শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। তাই দেবতা, নায়ক, দৈত্য, অভিশাপ, অলৌকিক ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে।
* আদর্শ চরিত্র গঠন: ধর্মীয় গল্পগুলোতে এমন চরিত্র তৈরি করা হয় যাদের নৈতিকতা, সাহস বা আত্মত্যাগ অনুকরণীয় হিসেবে দেখানো হয়—যেমন রাম, কৃষ্ণ, মুসা, ঈসা, মুহাম্মদ, বুদ্ধ। এগুলো মানুষকে প্রভাবিত করত।
* ভয়ের ব্যবহার: অনেক গল্পে এমন দৃশ্য দেখানো হয়—যেখানে কেউ ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করায় অভিশপ্ত হয়, মারা যায় বা শাস্তি পায়। এতে শ্রোতা শিক্ষা নিতো—"ঈশ্বরের কথা মানতেই হবে"।
*লৌকিক ও অলৌকিকের মিশ্রণ: পুরাণে বাস্তব জগতের সঙ্গে অলৌকিক জগতকে মিশিয়ে দেওয়া হয়—যেমন আকাশে উড়ে যাওয়া, দৈত্যদের সাথে যুদ্ধ, মৃতকে জীবিত করা ইত্যাদি। এগুলো বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বাসকে রহস্যময় ও মজার করে তোলে।
এইভাবে, ধর্মীয় গল্প ও পুরাণ শুধু বিশ্বাস নয়, একটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হয়ে ওঠে—যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে মানুষের মন ও চিন্তাকে গঠন করেছে।
৬. ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতা: রাজারা কেন ধর্মকে ব্যবহার করেছে?
যখন সমাজ ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় রূপ নেয় এবং বড় বড় রাজ্য ও সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন শাসকদের জন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আরও জটিল হয়ে পড়ে। তখন ধর্ম রাজনীতির একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে ওঠে।
* রাজারা ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতো: অনেক রাজা দাবি করতো, তারা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে শাসন করছে। যেমন: প্রাচীন মিশরের ফেরাউনরা নিজেদের “দেবতা” বলেই পরিচয় দিত। এতে প্রজারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস পেত না, কারণ সেটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হতো।
* ধর্মীয় অনুমোদনের গুরুত্ব: কোন রাজা যদি পুরোহিতদের সমর্থন পেত, তাহলে তারা বলতো, “ঈশ্বর এই রাজাকে মনোনীত করেছেন”। এতে জনগণ সেই রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতো, এমনকি জুলুমের পরও।
* ধর্মীয় যুদ্ধ ও জিহাদ: শাসকেরা ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ করাতো—“ঈশ্বরের নামে যুদ্ধ”, “অবিশ্বাসীদের ধ্বংস করা”, “পবিত্র ভূমি পুনর্দখল করা” ইত্যাদি যুক্তিতে। এতে সৈন্যরা মরতেও রাজি হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করতো যে তারা মরলে স্বর্গ পাবে।
* আইন ও শাস্তির বৈধতা: শাসকরা ধর্মের নামে কঠোর আইন জারি করতো—যেমন ধর্মীয় অবমাননায় শাস্তি, নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ড, নারীদের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি—আর বলতো, “এটা ঈশ্বরের নির্দেশ”।
অর্থাৎ, ধর্ম ছিল একদিকে জনগণের নিয়ন্ত্রণের উপায়, অন্যদিকে শাসকের ক্ষমতার বৈধতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বের নিশ্চয়তা।
৭. ধর্ম কীভাবে সময়ের সাথে বদলাতে থাকে: সংস্কার ও বিভাজন
ধর্মকে আমরা অনেক সময় মনে করি একবারে তৈরি হয়ে গেছে এবং চিরকাল একরকম আছে। কিন্তু বাস্তবে ধর্ম সময়ের সাথে পাল্টায়, ভেঙে যায়, নতুন ব্যাখ্যা জন্ম নেয়, সংস্কার আসে, এবং বহু উপধর্ম ও মতভেদের সৃষ্টি হয়।
* সময়ের প্রভাব: সমাজ যখন পরিবর্তিত হয়—নতুন জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, জীবনধারার পরিবর্তন আসে—তখন পুরোনো ধর্মীয় নিয়মগুলো অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে।
* ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন: অনেক ধর্মে সময়ের সাথে ‘সংস্কারবাদী’ মানুষ এসেছে যারা পুরনো কুসংস্কার বা অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। যেমন: হিন্দু ধর্মে বেদান্ত ও ভক্তি আন্দোলন, খ্রিস্টধর্মে মার্টিন লুথারের সংস্কার, ইসলামে বিভিন্ন “ইজতিহাদ” প্রচেষ্টা।
* বিভাজন ও উপধর্মের জন্ম: অনেক সময় মতভেদ এতই গভীর হয় যে ধর্ম ভেঙে আলাদা উপধর্ম হয়ে যায়। উদাহরণ:
* হিন্দু ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম জন্ম নেয়।
* খ্রিস্টধর্ম ভাগ হয় ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্সে।
* ইসলাম ভাগ হয় সুন্নি, শিয়া, আহমদিয়া, সালাফি, সুফি ইত্যাদিতে।
স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব: একটি ধর্ম এক অঞ্চলে একরকম, অন্য অঞ্চলে অন্যরকম রূপ নেয়। যেমন: চীনে বৌদ্ধ ধর্মের রূপ একরকম, আবার থাইল্যান্ডে ভিন্ন; আরবের ইসলাম একরকম, ইন্দোনেশিয়ায় ভিন্ন।
এইভাবে, ধর্ম কখনোই একরকম থাকে না। মানুষের চিন্তা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, সমাজব্যবস্থা—সবকিছুর সাথে পাল্টে যায় ধর্মও।
৮. ধর্ম কেন টিকে গেল? ধর্মের উপকারিতা কী ছিল?
প্রশ্ন হতে পারে—যদি ধর্ম মানুষের কল্পনা, ভয় বা রাজনীতির হাতিয়ার হয়, তাহলে এটা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে কেন? এর কারণ হলো, ধর্ম সমাজে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ পালন করেছে, যা তাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
* নৈতিক কাঠামো তৈরি: ধর্ম মানুষকে বলেছে কী ভালো, কী মন্দ। যেমন: চুরি খারাপ, মিথ্যা খারাপ, দান ভালো, সহানুভূতি ভালো। এইসব নৈতিক নির্দেশ সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।
* আইন ও শাস্তির ভিত্তি: ধর্মীয় নিয়মের মাধ্যমে সমাজে আচরণের নিয়ম তৈরি হয়েছে। যেমন: “ঈশ্বর দেখছে” বা “পাপ করলে শাস্তি হবে” — এই বিশ্বাস মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখত।
* একতা ও পরিচয়: একই ধর্ম মানে এক জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে একধরনের একতা। তারা একসাথে উৎসব করে, উপাসনা করে, একসাথে যুদ্ধও করে—এটা একটা সামাজিক বন্ধন তৈরি করে।
* জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য দেয়: মানুষ যখন জন্ম-মৃত্যু, দুঃখ-ব্যথা, দুর্যোগ ইত্যাদি নিয়ে হতাশ হতো, তখন ধর্ম তাকে আশ্বাস দিত—"এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা", "পরকালে পুরস্কার পাবে", "তুমি একা না"। এটা মানুষকে মানসিক শান্তি দিত।
* জ্ঞান ও শিল্পচর্চার উত্স: প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠশালা, জ্যোতিষ, গণিত, স্থাপত্য, সংগীত, সাহিত্য চর্চা হতো। ধর্মীয় স্থাপত্য যেমন গির্জা, মন্দির, মসজিদ ইত্যাদি শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন।
অর্থাৎ, ধর্ম শুধু অন্ধ বিশ্বাস নয়, সমাজ গঠনের জন্য অনেক কাজ করেছিল বলেই তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে গেছে।
৯. আধুনিক যুগে ধর্মের ভূমিকা ও সংকট
বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, মানবাধিকার এবং প্রযুক্তির বিস্ফোরণের এই আধুনিক যুগে ধর্ম আর আগের মতো প্রভাবশালী নয়—তবে একেবারে বিলুপ্তও হয়নি। বরং ধর্ম এক নতুন সংকটের মুখোমুখি, যেখানে তার অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে যুক্তি, প্রমাণ এবং মানবিক নীতির ভিত্তিতে।
* বিজ্ঞান ধর্মীয় দাবিকে চ্যালেঞ্জ করছে: পৃথিবী ৬ দিনে তৈরি হয়নি, মানুষ আদম থেকে আসেনি, সৌরজগতের কেন্দ্র পৃথিবী নয়—এইসব প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তথ্য ধর্মীয় কাহিনিগুলোর বিরোধিতা করছে। এতে ধর্মের বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়ছে।
* যুক্তিবাদ ও সংশয়বাদ: মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শিখছে—“কোথা থেকে জানো এটা সত্য?”, “এত কষ্ট হলে ঈশ্বর কী করছে?”, “সব ধর্মই যদি সত্য হয়, তাহলে কোনটা আসল?”—এইসব প্রশ্ন ধর্মকে জবাবদিহির মুখে ফেলছে।
* ধর্ম ও মানবাধিকার সংঘাত: অনেক ধর্মীয় বিধান যেমন নারীকে অবনমিত করা, সমকামিতাকে অপরাধ বলা, ধর্মান্তরকে শাস্তিযোগ্য করা—এইসব আজকের মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আধুনিক সমাজে ধর্মীয় নীতি অনেক সময় সমালোচনার শিকার হয়।
* ধর্মনিরপেক্ষতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা: অনেক মানুষ এখন বলে—"ধর্ম আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার", বা "আমার কোনো ধর্ম নেই"। রাষ্ট্রও ধর্ম থেকে আলাদা থাকার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা দেশগুলোয় এটা ব্যাপকভাবে ঘটছে।
* ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আজও আছে: যদিও ধর্ম দুর্বল হচ্ছে, কিন্তু কিছু রাষ্ট্র ও রাজনীতি এখনো ধর্মকে কাজে লাগিয়ে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, জিহাদবাদ, ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো ইত্যাদি।
অর্থাৎ, আধুনিক যুগে ধর্ম এখন এক রূপান্তরের সময় অতিক্রম করছে—কেউ ধর্ম ত্যাগ করছে, কেউ নতুনভাবে ধর্মকে ব্যাখ্যা করছে, কেউ আবার ধর্মের নামে জোর করছে।
১০. ভবিষ্যতে ধর্মের পরিণতি: টিকে থাকবে না নাকি বিলুপ্ত হবে?
ধর্মের হাজার বছর ধরে টিকে থাকার পর এখন প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে ধর্মের অবস্থা কী হবে? আধুনিক জ্ঞানের আলোকে ধর্ম কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে নাকি নতুন রূপে বেঁচে থাকবে?
ধর্ম বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা:
*আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে মানুষের অনেক বিশ্বাস বদলাচ্ছে। অনেকেই ধর্মকে অপ্রমাণিত বা অযৌক্তিক মনে করে ছেড়ে দিচ্ছে।
*পশ্চিমা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক মানুষ ‘অ-ধর্মী’ বা ‘নাস্তিক’ হয়ে উঠছে।
* ধর্মের কড়া বিধান ও কুসংস্কার আধুনিক নৈতিকতার সাথে খাপ খায় না, তাই নতুন প্রজন্ম ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
ধর্ম টিকে থাকার কারণ:
*মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মানসিক শান্তির চাহিদা সবসময়ই থাকবে। ধর্ম সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে।
*সামাজিক বন্ধন, ঐতিহ্য ও পরিচয় হিসেবে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
*ধর্ম সংস্কারের মধ্য দিয়ে নিজেকে আধুনিক ও যুক্তিপূর্ণ করে তুলতে পারে, যা টিকে থাকার সুযোগ বাড়ায়।
বিকল্প পথ:
* ধর্মের বিকল্প হিসেবে মানবতাবাদ, নৈতিকতা ভিত্তিক জীবনদর্শন ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা সমাজে আরও প্রসার পেতে পারে।
অনেক মানুষ আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতা বজায় রেখে ধর্মের বাইরেও অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে।
সারাংশ: ধর্ম হয়তো তার পুরনো রূপে টিকে থাকবে না, কিন্তু তার কিছু মৌলিক চাহিদা ও কাজ অন্য কোনো রূপে থেকে যেতে পারে। সময় ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ধর্মের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে।